সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। এই অভিযোগের তদন্তে যুক্তরাজ্যের লেবার পার্টির মিনিস্টার টিউলিপ সিদ্দিকের নামও এসেছে। টিউলিপ ব্রিটিশ লেবার সরকারের অর্থমন্ত্রী (ইকোনমিক সেক্রেটারি টু দ্য ট্রেজারি) এবং সিটি মিনিস্টার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন, তার বিরুদ্ধে ৩.৯ বিলিয়ন পাউন্ড আত্মসাতে সহায়তার অভিযোগ রয়েছে।
অভিযোগের প্রেক্ষাপট
২০১৩ সালে বাংলাদেশে রাশিয়ার সঙ্গে একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ চুক্তিতে টিউলিপ সিদ্দিক মধ্যস্থতা করেন বলে অভিযোগ উঠেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চুক্তিতে প্রকল্পের ব্যয় কৃত্রিমভাবে বাড়ানো হয়, যা থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে। অভিযোগে শেখ হাসিনার পরিবারের সদস্যদের পাশাপাশি টিউলিপ সিদ্দিক এবং অন্যান্য মন্ত্রীদের নামও উঠে এসেছে।
জিজ্ঞাসাবাদ ও তদন্ত প্রক্রিয়া
গত ২১ ডিসেম্বর যুক্তরাজ্যের মন্ত্রিপরিষদ অফিসের ন্যায় এবং নৈতিকতা দল (প্রোপ্রাইটরি অ্যান্ড এথিক্স টিম - PET) টিউলিপ সিদ্দিককে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য সানডে টাইমস এ তথ্য প্রকাশ করে। তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়, টিউলিপ স্বেচ্ছায় ন্যায় ও নৈতিকতা দলের সঙ্গে বৈঠকে অংশগ্রহণ করেন এবং নিজের অবস্থান পরিষ্কার করেন।
টিউলিপের অফিসে গিয়ে এই তদন্তকারীরা অভিযোগের প্রমাণ এবং তার ভূমিকা নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। রূপপুর প্রকল্প থেকে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে তার জড়িত থাকার বিষয়টি নাকচ করে দিয়েছেন টিউলিপ।
অন্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগ
শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় এবং বোন শেখ রেহানার বিরুদ্ধেও এই প্রকল্পের অর্থ আত্মসাতে সরাসরি জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনার সরকারের সময়ে রূপপুর প্রকল্পের মাধ্যমে প্রায় ৪ বিলিয়ন পাউন্ড আত্মসাৎ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ইতোমধ্যে শেখ হাসিনার পরিবারের সদস্য এবং আওয়ামী লীগের একাধিক মন্ত্রী ও কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালও মানবাধিকার লঙ্ঘন ও দুর্নীতির অভিযোগে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে।
যুক্তরাজ্যের সরকারের অবস্থান
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী স্যার কিয়ার স্টারমার জানিয়েছেন, তিনি টিউলিপের ওপর আস্থা রাখছেন এবং তার মন্ত্রিত্ব অব্যাহত থাকবে। স্টারমার অভিযোগগুলোকে ভিত্তিহীন বলে উল্লেখ করেছেন এবং টিউলিপের পক্ষে সাফাই দিয়েছেন।
তবে তদন্ত প্রক্রিয়া এখনো চলমান, এবং পরবর্তী মাসে টিউলিপ সিদ্দিককে আবারো জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করা হতে পারে। বাংলাদেশ দুর্নীতি দমন কমিশনও ঢাকার ব্রিটিশ হাইকমিশনের মাধ্যমে যুক্তরাজ্যের কাছে টিউলিপের বিষয়ে আনুষ্ঠানিক চিঠি পাঠানোর পরিকল্পনা করেছে।
টিউলিপ সিদ্দিকের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার
টিউলিপ সিদ্দিক বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বোন শেখ রেহানার মেয়ে। তিনি ২০১৫ সালে প্রথমবারের মতো যুক্তরাজ্যের হ্যাম্পস্টেড অ্যান্ড হাইগেইট আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হন। এই আসনটি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের নির্বাচনী আসন হবর্ন অ্যান্ড সেন্ট প্যানক্রাসের সন্নিকটে।
টিউলিপ ব্রিটেনের লেবার সরকারের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে যুক্তরাজ্যের অর্থনীতি এবং আর্থিক খাতের শুদ্ধি অভিযানের দায়িত্বে রয়েছেন। কিন্তু রূপপুর প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ তার সুনাম ক্ষুণ্ণ করেছে।
বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি
বাংলাদেশে শেখ হাসিনার দীর্ঘ ২০ বছরের শাসনকালকে অনেকেই স্বৈরাচারী শাসন হিসেবে অভিহিত করেছেন। ২০২৪ সালের নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পর থেকে শেখ হাসিনা এবং তার সরকারের বিরুদ্ধে একাধিক দুর্নীতির মামলা দায়ের হয়েছে।
রূপপুর প্রকল্পের ৪ বিলিয়ন পাউন্ড আত্মসাত ছাড়াও মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং রাজনৈতিক দমন-পীড়নের অভিযোগে তাকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মুখোমুখি হতে হচ্ছে।
উপসংহার
টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়টি বাংলাদেশের রাজনীতিতেও বড় ধরনের প্রভাব ফেলেছে। যদিও তিনি নিজে এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন, তবে তদন্তের ফলাফল তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার এবং শেখ হাসিনা পরিবারের ভাবমূর্তিতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে।
যুক্তরাজ্য এবং বাংলাদেশের এই বহুমাত্রিক তদন্ত ভবিষ্যতে কী ধরনের প্রমাণ নিয়ে আসে, তা সময়ই বলে দেবে।
আপনার মতামত লিখুন :