চট্টগ্রামের রাউজানে নোয়াপাড়া ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডে শুক্রবার দুপুরে সন্ত্রাসীদের গুলিতে জাহাঙ্গীর আলম (৫৫) নামে একজন শুঁটকি ব্যবসায়ী নিহত হয়েছেন। একই ঘটনায় মুহাম্মদ আব্বাস (৩৮) নামে একজন গুরুতর আহত হয়েছেন। আব্বাস নিহত জাহাঙ্গীর আলমের মালিকানাধীন কমিউনিটি সেন্টারের ব্যবস্থাপক।
ঘটনার বিবরণ
স্থানীয় বাসিন্দা ও পুলিশ সূত্রে জানা যায়, শুক্রবার দুপুরে জুমার নামাজের সময় জাহাঙ্গীর আলম ও মুহাম্মদ আব্বাস একটি মোটরসাইকেলে করে মসজিদের দিকে যাচ্ছিলেন। মসজিদের কাছাকাছি পৌঁছানোর পরই কয়েকজন সন্ত্রাসী তাদের মোটরসাইকেলের গতিরোধ করে। তারা প্রথমে মোটরসাইকেল থেকে দুজনকে জোর করে নামিয়ে আঘাত করে এবং এরপর মাথার পেছনে গুলি চালায়। ঘটনাস্থলেই জাহাঙ্গীরের মৃত্যু নিশ্চিত হয়। গুরুতর আহত আব্বাসকে স্থানীয়রা উদ্ধার করে দ্রুত চট্টগ্রাম নগরের একটি হাসপাতালে ভর্তি করে।
প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, সন্ত্রাসীরা একাধিক সিএনজিচালিত অটোরিকশা এবং মোটরসাইকেলযোগে ঘটনাস্থলে আসে। তারা গুলিবর্ষণের পর দ্রুত চট্টগ্রাম-কাপ্তাই সড়ক হয়ে পালিয়ে যায়। মসজিদ থেকে কিছু দূরে ঘটনাটি ঘটায় নামাজরত মুসল্লিরা প্রথমে শব্দ শুনলেও বিস্তারিত কিছু বুঝতে পারেননি।
জাহাঙ্গীর আলমের চাচা আবু বক্কর বলেন, “আমরা মসজিদে খুতবা শুনছিলাম। হঠাৎ গুলির শব্দে সবাই বিচলিত হয়ে বাইরে ছুটে আসি। তখন দেখি রাস্তায় দুজন গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে আছে। দ্রুত তাদের হাসপাতালে নিয়ে যাই, কিন্তু চিকিৎসক জাহাঙ্গীরকে মৃত ঘোষণা করেন।”
নিহত ও আহতের পরিচয়
নিহত জাহাঙ্গীর আলম চট্টগ্রাম নগরের খাতুনগঞ্জের শুঁটকির পাইকারি ব্যবসা করতেন। তিনি এলাকার একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত ছিলেন এবং নিজ এলাকায় একটি কমিউনিটি সেন্টারও পরিচালনা করতেন। তিনি নোয়াপাড়া ইউনিয়নের সাবেক ইউপি সদস্য আবু সৈয়দের ছেলে। জাহাঙ্গীরের এই মৃত্যুতে পরিবার ও এলাকাবাসী শোকাহত।
আহত মুহাম্মদ আব্বাস জাহাঙ্গীর আলমের মালিকানাধীন কমিউনিটি সেন্টারের ব্যবস্থাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। তার চিকিৎসা বর্তমানে চট্টগ্রাম নগরের একটি হাসপাতালে চলছে। তার অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানা গেছে।
সন্ত্রাসী হামলার কারণ
এ ঘটনার পেছনে সন্ত্রাসীদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য এখনও পাওয়া যায়নি। স্থানীয়দের ধারণা, এটি পূর্ব-পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। জাহাঙ্গীর আলমের ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বিতা, এলাকায় তার প্রভাব, কিংবা রাজনৈতিক কোনো বিরোধ এর পেছনে কাজ করতে পারে।
তবে, রাউজান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এ কে এম শফিকুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, “সন্ত্রাসীদের গুলিতে একজন নিহত হয়েছেন এবং একজন আহত হয়েছেন। ঘটনাটি আমরা গুরুত্ব সহকারে তদন্ত করছি। এর পেছনে কারা জড়িত এবং তাদের উদ্দেশ্য কী, তা খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছে।”
স্থানীয়দের প্রতিক্রিয়া
জাহাঙ্গীর আলমের মৃত্যুর ঘটনায় নোয়াপাড়া ইউনিয়নসহ পুরো এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে। স্থানীয় বাসিন্দারা এ ধরনের নির্মম হত্যাকাণ্ডে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তাদের মতে, দিনের বেলা জনবহুল এলাকায় এভাবে প্রকাশ্যে গুলি চালানোর ঘটনা নিরাপত্তার অভাবকেই তুলে ধরেছে।
স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, “জাহাঙ্গীর সাহেব আমাদের এলাকায় একজন সজ্জন ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তার সঙ্গে কারো শত্রুতা থাকার কথা নয়। যারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে, তাদের দ্রুত গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া উচিত।”
আরেক বাসিন্দা বলেন, “এই এলাকায় এর আগে এমন ঘটনা কখনো ঘটেনি। আমরা নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন। প্রশাসনকে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে।”
প্রশাসনের পদক্ষেপ
ঘটনার পরপরই পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে আলামত সংগ্রহ করেছে। হামলাকারীদের শনাক্ত করতে সিসিটিভি ফুটেজ এবং স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য যাচাই করা হচ্ছে। রাউজান থানার ওসি বলেন, “আমরা সন্ত্রাসীদের দ্রুত গ্রেপ্তার করতে অভিযান শুরু করেছি। এ ঘটনায় জড়িতদের চিহ্নিত করতে সব ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে।”
পুলিশের পাশাপাশি স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও প্রশাসনের প্রতি দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
জাহাঙ্গীর আলমের সামাজিক ও ব্যবসায়িক অবদান
জাহাঙ্গীর আলম একজন সুনামধন্য ব্যবসায়ী ছিলেন। চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে তার শুঁটকির পাইকারি ব্যবসা দীর্ঘদিন ধরে চালু ছিল। ব্যবসার পাশাপাশি তিনি তার এলাকায় সামাজিক উন্নয়নে কাজ করতেন। তার পরিচালিত কমিউনিটি সেন্টারটি এলাকার সামাজিক অনুষ্ঠান এবং জনকল্যাণমূলক কাজে ব্যবহৃত হতো। তার মৃত্যুর ফলে পরিবার এবং সমাজ এক বিশাল ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে।
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সন্ত্রাসী কার্যক্রমের প্রবণতা
বাংলাদেশে সম্প্রতি সন্ত্রাসী হামলার প্রবণতা কিছুটা কমে এলেও মাঝেমধ্যে বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ঘটছে। বিশেষত গ্রামীণ এলাকায় ব্যবসায়ী ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের লক্ষ্য করে হামলার ঘটনাগুলো সামাজিক অস্থিরতা তৈরি করছে। এর পেছনে প্রভাবশালী মহল, স্থানীয় বিরোধ বা রাজনৈতিক স্বার্থ জড়িত থাকার সম্ভাবনা থাকে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই ধরনের ঘটনার পেছনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির অভাব একটি বড় কারণ। অপরাধীরা অনেক সময় আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে পার পেয়ে যায়, যা এ ধরনের অপরাধ বাড়িয়ে তোলে।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে করণীয়
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এ ধরনের সন্ত্রাসী কার্যক্রম রোধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আরও সক্রিয় হতে হবে। স্থানীয় প্রশাসনকে নজরদারি বাড়ানোর পাশাপাশি জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্য কাজ করতে হবে।
এ ছাড়া স্থানীয় বিরোধ বা প্রতিহিংসার বিষয়ে দ্রুত সমাধান নিশ্চিত করার জন্য গ্রাম্য সালিশ বা প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। দীর্ঘমেয়াদে এ ধরনের সহিংসতা এড়াতে সামাজিক সম্প্রীতি এবং আইন-শৃঙ্খলার উন্নয়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
আপনার মতামত লিখুন :