সমাজে পরকীয়া বেশ বিতর্কিত ও স্পর্শকাতর একটি বিষয় এবং এটি কখনোই কোনো স্থায়ী সম্পর্ক নয়। বিবাহিত পুরুষরা কেন পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়েন তার পেছনে রয়েছে মানসিক, সামাজিক, ব্যক্তিগত ও সাংস্কৃতিক বিভিন্ন কারণ। এখানে বিভিন্ন কারণ বিশ্লেষণ করে পরকীয়ার প্রভাব, মনস্তাত্ত্বিক বিষয় এবং প্রতিকার নিয়ে আলোচনা করা হলো।
পরকীয়ার পেছনে সাধারণ কারণ
১. সাংসারিক অশান্তি এবং আগ্রহের অভাব
বিবাহিত জীবনে অনেক সময় দম্পতিরা একে অপরের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। এতে আবেগের ঘাটতি দেখা দিতে পারে। যার কারনে কিছু পুরুষ নিজেকে অবহেলিত বা একাকী বোধ করতে পারেন। তখন আবেগের ঘাটতি মেটানোর জন্য তারা বাইরের সম্পর্কের দিকে ঝুঁকতে পরেন।
২. সম্পর্কের একঘেয়েমি
দীর্ঘ সময় ধরে এক সম্পর্কের মধ্যে থাকা অনেকের জন্য একঘেয়েমির জন্ম দিতে পারে। একঘেয়েমি বা রুটিন জীবন থেকে বেরিয়ে নতুন রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা বা সম্পর্কের প্রতি আকর্ষণ অনেকেরই জন্মায়। নতুনত্বের প্রতি এই আগ্রহ অনেক বিবাহিত পুরুষকে পরকীয়ার দিকে ধাবিত করে।
৩. পরনারীর প্রশংসায় আকর্ষন অনুভব
কিছু পুরুষ মনে করেন নতুন কেউ তাদের প্রশংসা করলে তারা আকর্ষিত হয় যা তাদের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে তোলে। তাদের নিজস্ব সক্ষমতা, পুরুষত্ব ও আকর্ষণের মাপকাঠি তারা বাইরের সম্পর্কের মাধ্যমে পরখ করতে গিয়ে জড়িয়ে পরেন পরকীয়ায়।
৪. যৌন সুখের চাহিদা
বেশির ভাগ পরকীয়ার ক্ষেত্রে দেখা গেছে বিবাহিত জীবনে দম্পতিরা স্বাভাবিক যৌন সম্পর্ক হারিয়ে ফেলে বা স্বামী- স্ত্রীর মধ্যে যৌন আকাঙ্খা কমে যায়। এই অভাব পূরণ করতে এবং যৌন সুখ খুজে পেতে অনেক পুরুষ নতুন সম্পর্ক খুঁজে থাকেন।
৫. ব্যক্তিগত সমস্যা এবং অনিয়ন্ত্রিত আবেগ
ব্যক্তিগত সমস্যা যেমন কর্মক্ষেত্রের চাপ, পরিবারের ঝামেলা, আর্থিক সমস্যা নিরসন কিংবা চারিত্রিক ভাবে লম্পট পুরুষ একটু বেশিই পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়েন। পরকীয়া তাদের কাছে কিছুক্ষণের জন্য হলেও মানসিক প্রশান্তির দেয়। প্রয়োজনে তারা একাধিক পরকীয়ায়ও জড়ায়।
সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক প্রভাব
১. মিডিয়া এবং সমাজের অধঃপতন
সিনেমা, সিরিজ, সাহিত্য ও অন্যান্য মিডিয়ার মাধ্যমে প্রায়ই পরকীয়াকে রোমাঞ্চকর ও উত্তেজনাময় করে উপস্থাপন করা হয়। এই উপস্থাপনায় অনেকেই লালায়িত হন এবং নতুন অভিজ্ঞতার স্বাদ নিতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন।
২. সাংস্কৃতিক প্রভাব এবং পারিবারিক মনোভাব
কিছু সমাজে পরকীয়া সম্পর্কে কোনো কঠোর মতবাদ না থাকায় পুরুষরা এটাকে কখনোই নিষিদ্ধ বলে মানেন না। এই কারণেই তারা দ্বিধাবোধ ছাড়াই পরকীয়ায় জড়িয়ে পরেন। এমনকি কিছু পরিবারে পরকীয়া সম্পর্কে নমনীয় মনোভাব থাকায় কেউ কেউ ধরে নেয় পরকীয়া যেন ডাল ভাতের মতই স্বাভাবিক বিষয়।
৩. বন্ধুদের প্রভাব
অনেক সময় বন্ধুমহলে এমন লোক থাকতে পারে যারা পরকীয়াকে স্বাভাবিকভাবে নেন এবং কেউ পরকীয়ায় জড়ালে তার প্রশংসা করে আরো উস্কে দেন। এইসকল বন্ধুবান্ধবের সান্নিধ্যে থাকলে যে কেউ পরকীয়ার দিকে আকৃষ্ট হয়ে পরবে।
পরকীয়ার নেতিবাচক প্রভাব
১. পারিবার ধ্বংসের সূচনা
পরকীয়া এমনই এক মহামারী যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিবাহবিচ্ছেদের দিকে নিয়ে যায়। কিন্তু এই দুর্ঘটনার সবচেয়ে বড় ভিক্টিম হয় দম্পতির সন্তানরা। পিতা মাতার কলহপূর্ন দাম্পত্য দেখে দেখে তাদের মানসিক বিকাশেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। পরিবারে পারস্পরিক বিশ্বাসে একবার ভাঙন দেখা দিলে তা সম্পর্কগুলিকে চিরতরে নষ্ট করে দেয়।
২. মানসিক চাপ এবং আত্মগ্লানি
যারা পরকীয়ায় জড়ান তাদের মধ্যে প্রায়ই অপরাধবোধ এবং আত্মগ্লানি সৃষ্টি হয়। লুকোচুরি, মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া ইত্যাদি কারণে তারা প্রায়ই মানসিক চাপে থাকেন।
৩. আর্থিক ক্ষতি
বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পরকীয়ার সম্পর্ক আর্থিক ভাবে নিঃস্ব করে দেয়। একাধিক সম্পর্কের ব্যয়, গোপনীয়তা বজায় রাখার জন্য বিভিন্ন রকম খরচ, জানাজানি হয়ে গেলে কিংবা আইনি ঝামেলায় পড়লে অর্থের অনর্থ ঘটেই।
প্রতিকার ও সমাধান
১. দাম্পত্য জীবন মজবুত করা
একটি সফল ও সন্তোষজনক সম্পর্কের জন্য খোলামেলা আলোচনা খুবই জরুরি।নিজেদের মধ্যে সময় নিয়ে আলোচনা করা, উভয়ের ইচ্ছা/ অনিচ্ছা ও সমস্যা শেয়ার করা এবং একে অপরকে বোঝার চেষ্টা করাই সম্পর্ককে মজবুত করতে পারে।
২. পেশাদার পরামর্শ গ্রহণ
একটা সম্পর্কের সমস্যা কখনোই দ্বিতীয় সম্পর্ক দ্বারা মেটানো সম্ভব নয়। এতে সমস্যা আরো তিনগুন হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। তাই সময় মত মনোবিদ বা সম্পর্ক বিশেষজ্ঞের সাহায্য নেওয়া পরকীয়া সম্পর্কের ঝুঁকি অনেকাংশে কমাতে পারে। তাদের পরামর্শ গ্রহণ করলে ব্যক্তিগত মানসিক সমস্যা এবং দাম্পত্য জীবনের সমস্যা সমাধানের পথ খুজে পাওয়া সম্ভব।
৩. বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের চর্চা
দাম্পত্য জীবনে ভালো বন্ধুত্ব থাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একজন স্বামী-স্ত্রীকে ভালো বন্ধু হিসেবে মেনে নিয়ে তাদের সাথে সময় কাটানো সম্পর্ককে যথেষ্ট শক্তিশালী করে তুলতে সাহায্য করে।
৪. রোম্যান্টিক সম্পর্ক জাগিয়ে তোলা
একঘেয়েমি রুটিন বাদ দিয়ে সম্পর্কে নতুনত্ব আনার জন্য বেশি বেশি রোমান্টিক মুহূর্ত তৈরি করা বা একসাথে নতুন কিছু করার পরিকল্পনা করা যেতে পারে। এতে নতুন নতুন অভিজ্ঞতার মাধ্যমে একে অপরের প্রতি আকর্ষণ বাড়িয়ে তোলে।
উপসংহার
পরকীয়া একটি ব্যাধি। সঠিক সময়ে সঠিক ভাবে বুঝতে এবং সমাধান করতে দাম্পত্য জীবনে খোলামেলা আলোচনা, বন্ধুত্ব এবং একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ প্রয়োজন। সম্পর্কের প্রতি মনোযোগী হলে এবং ব্যক্তিগত সমস্যাগুলি সঠিকভাবে সমাধান করলে অনেক ক্ষেত্রেই পরকীয়ার প্রতি আকর্ষণ কমে আসে।
আপনার মতামত লিখুন :