বাংলাদেশ রবিবার, ২৩ মার্চ, ২০২৫, ৮ চৈত্র ১৪৩১

হাইতিতে শিশু যৌন নিপীড়ন বেড়েছে ১০০০%: ইউনিসেফের উদ্বেগ

দৈনিক প্রথম সংবাদ ডেস্ক

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ৭, ২০২৫, ০৯:৫১ পিএম

হাইতিতে শিশু যৌন নিপীড়ন বেড়েছে ১০০০%: ইউনিসেফের উদ্বেগ

হাইতি, ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের একটি দেশ, বর্তমানে অত্যন্ত বিপর্যস্ত অবস্থায় রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে গ্যাং নিয়ন্ত্রিত দেশটির পরিস্থিতি ক্রমেই আরো খারাপ হচ্ছে, বিশেষত শিশুরা যে ধরনের সহিংসতা ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছে তা অনেকের জন্য অপ্রত্যাশিত। জাতিসংঘের শিশু সংস্থা (ইউনিসেফ) সম্প্রতি হাইতিতে শিশুদের বিরুদ্ধে যৌন সহিংসতার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এ ধরনের সহিংসতার ঘটনা ২০২৩ সাল থেকে এক হাজার শতাংশ বেড়ে গেছে। এটি শুধু হাইতির জন্য একটি ভয়াবহ সংকটই নয়, বরং বিশ্বের জন্যও একটি মানবাধিকার লঙ্ঘনের বড় উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

হাইতির পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যেখানে একটি শিশু যেন যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হচ্ছে। জাতিসংঘের মুখপাত্র জেমস এল্ডার বলেছেন, "শিশুদের শরীর যেন এখন যুদ্ধক্ষেত্র হয়ে উঠেছে," এবং এর কারণ গ্যাংদের বর্বর আচরণ। হাইতিতে গ্যাংগুলোর তাণ্ডবের ফলে স্কুল ও হাসপাতাল বন্ধ হয়ে গেছে, খাদ্য নিরাপত্তা সংকট দেখা দিয়েছে, এবং শিশুদের মৌলিক প্রয়োজনগুলোও পূর্ণ হয়নি। ২০২৩ সালের পর থেকে, শিশুদের বিরুদ্ধে যৌন সহিংসতা, শারীরিক অত্যাচার এবং অপহরণের ঘটনা আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। শিশুদের নির্যাতন, ধর্ষণ, এবং যৌন নিপীড়নের ঘটনা এক ভয়াবহ মাত্রায় পৌঁছেছে। এটি শুধু শিশুদের শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি করতে পারে না, বরং দেশের ভবিষ্যতকেও বিপর্যস্ত করে দিচ্ছে।

বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল বা কমিউনিটি সেন্টার—এমন সব জায়গায় যেখানে সাধারণত শিশুদের শিক্ষার ব্যবস্থা থাকে, সেখানে গ্যাং সদস্যদের তাণ্ডব চলছে। শিশুদের অবস্থা এতই নাজুক যে, অনেক পরিবার তাদের সন্তানদেরকে বাড়ির বাইরে পাঠাতে ভয় পায়। হাইতির রাজধানী পোর্ট-অ-প্রিন্সের এক বড় অংশ, প্রায় ৮৫% এলাকা, এখন গ্যাংদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এই গ্যাংগুলো সাধারণ জনগণের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে এবং পরিবারগুলোকে চাঁদা দেওয়ার জন্য জোর করে সন্তানদের অপহরণ করছে। একাধিক শিশু অপহরণ হওয়ার পর তাদের পরিবারদের কাছে মুক্তিপণ দাবি করা হচ্ছে। ইউনিসেফের প্রতিবেদন অনুযায়ী, অনেক সময় এসব শিশুদের আটকে রেখে মুক্তিপণ না পাওয়া পর্যন্ত অত্যাচার করা হচ্ছে, যার ফলে তারা গভীর মানসিক ও শারীরিক ক্ষতির শিকার হচ্ছে।

একটি উদাহরণ হিসেবে, একটি ১৬ বছর বয়সী মেয়েকে হাইতি থেকে অপহরণ করে গ্যাং সদস্যরা। তাকে প্রায় এক মাস আটকে রেখে নানা ধরনের নির্যাতন চালানো হয়, এবং তার পরিবারের কাছ থেকে মুক্তিপণ দাবি করা হয়। যখন গ্যাংয়ের সদস্যরা বুঝতে পারে যে মেয়েটির পরিবারের কাছে মুক্তিপণের জন্য অর্থ নেই, তখন তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। এই ধরনের ঘটনা এখন হাইতিতে অত্যন্ত সাধারণ হয়ে উঠেছে। গ্যাংয়ের সদস্যরা শুধু বড়দেরই নয়, বরং শিশুদেরও শিকার করে এবং তাদের গ্যাংয়ের সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে। এমনকি আট বছরের শিশুদেরও গ্যাংয়ে দেখা গেছে, যারা জোর করে গ্যাংয়ের সদস্য হয়ে উঠছে।

হাইতির স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা সেবা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে এবং একাধিক পরিবার স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত। এর ফলে শিশুরা যে মৌলিক স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার কথা, তা পাচ্ছে না। পাশাপাশি, শিক্ষাব্যবস্থা পুরোপুরি বিপর্যস্ত। স্কুলগুলো বন্ধ হয়ে গেছে অথবা সেগুলোর কার্যক্রম খুবই সীমিত হয়ে পড়েছে, ফলে হাজার হাজার শিশু শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। জাতিসংঘের মতে, একটি শিশুর মৌলিক চাহিদা যেমন শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা এবং নিরাপদ পরিবেশ—এসব কিছুই তারা পাচ্ছে না।

এমন কঠিন পরিস্থিতিতে, ইউনিসেফ হাইতিতে শিশুদের জন্য ভ্রাম্যমাণ নিরাপদ স্থান তৈরি করেছে। এই নিরাপদ স্থানগুলোতে শিশুরা অন্তত কিছু সময়ের জন্য সহিংসতা থেকে পালাতে পারে। তবে, তাদের এই সহায়তা কার্যক্রমের জন্য প্রয়োজনীয় তহবিল খুবই সীমিত। গত বছর ২২১.৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সহায়তা চাওয়া হয়েছিল, কিন্তু তার মাত্র এক-চতুর্থাংশই পাওয়া গেছে। তহবিলের অভাবের কারণে ইউনিসেফের জন্য কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া এবং হাইতির পরিস্থিতি মোকাবেলা করা খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে।

এছাড়া, গ্যাংয়ের সদস্যরা দেশটির আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে ভেঙে ফেলেছে। পুলিশ ও অন্যান্য আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর ক্ষমতা নেই গ্যাংদের বিরুদ্ধে কার্যকরভাবে লড়াই করার। এর ফলে, গ্যাং সদস্যরা যতটা ইচ্ছা ততটা নির্যাতন চালাতে পারছে এবং পুলিশ তাদের আটক করতে পারছে না। এটি দেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে আরও অবনতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

হাইতির জন্য জাতিসংঘের সতর্কতা এক গুরুতর সংকেত। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে হাইতির পরিস্থিতির দিকে নজর দিতে হবে এবং তাদের সহায়তা বাড়াতে হবে। শিশুদের জন্য জরুরি সহায়তা পাঠানো, তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা, এবং দেশের স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ব্যবস্থাকে পুনর্গঠন করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শুধু তহবিল বৃদ্ধি করলেই হবে না, বরং হাইতিতে একটি শান্তিপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করতে হবে যাতে শিশুদের ভবিষ্যৎ সুস্থ ও নিরাপদ থাকে।

হাইতিতে গ্যাংগুলোর ব্যাপক আধিপত্য এবং দেশের বিভিন্ন সংকট মিলিয়ে, শিশুদের সহায়তার জন্য জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। শিশুরা যেহেতু জাতির ভবিষ্যৎ, তাদের সুরক্ষা এবং উন্নতির জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। হাইতির শিশুদের প্রতি সহিংসতা বন্ধ করতে হলে দেশটির আইনশৃঙ্খলা, স্বাস্থ্যসেবা, এবং শিক্ষাব্যবস্থাকে পুনর্গঠন করতে হবে। এক্ষেত্রে, জাতিসংঘের দৃষ্টি আকর্ষণ এবং আন্তর্জাতিক সহায়তা জরুরি হয়ে পড়েছে।

হাইতিতে শিশুদের সহিংসতা, অপহরণ, যৌন নিপীড়ন এবং গ্যাংয়ের দ্বারা অত্যাচারের ঘটনা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। এই পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে একযোগে কাজ করতে হবে। শুধুমাত্র আর্থিক সহায়তা নয়, বরং আইনি পদক্ষেপ, সুরক্ষা ব্যবস্থা এবং শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতির মাধ্যমে হাইতির শিশুদের ভবিষ্যৎ রক্ষা করা সম্ভব হবে।

Link copied!

সর্বশেষ :