অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন ও মানসিক চাপ ডায়াবেটিস বাড়াচ্ছে
বাংলাদেশে দ্রুত বাড়ছে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা। অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস, মানসিক চাপ, বসে কাজের জীবনধারা ও শারীরিক পরিশ্রমের অভাবকে বিশেষজ্ঞরা এই বৃদ্ধির মূল কারণ হিসেবে দেখছেন। আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশনের (আইডিএফ) তথ্য অনুযায়ী দেশে বর্তমানে অন্তত এক কোটি ৩৮ লাখ মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি, হতে পারে ৩ কোটিরও বেশি।এমন প্রেক্ষাপটে আজ বিশ্বজুড়ে পালিত হচ্ছে বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস, যার এবারের প্রতিপাদ্য, কর্মস্থলে ডায়াবেটিস সচেতনতা গড়ে তুলুন।
ডায়াবেটিস বাড়ছে দ্রুতবাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির সাম্প্রতিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, দেশে প্রতি চারজন প্রাপ্তবয়স্কর একজন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হতে পারেন। ২০১৮ সালের একটি বৃহৎ সমীক্ষায়ও একই চিত্র উঠে আসে।ডেটা বলছে-২০১৫–১৬ সালে নিবন্ধিত রোগী: ৩৫.১০ লাখ২০২৩–২৪ সালে নিবন্ধিত রোগী: ৬৫ লাখসংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় স্বাস্থ্যব্যবস্থার ওপর বাড়ছে চাপ।
কেন বাড়ছে ডায়াবেটিসবিশেষজ্ঞরা বলছেন, শহুরে কর্মজীবন ডায়াবেটিস বৃদ্ধির সবচেয়ে বড় কারণ।মূল ঝুঁকিগুলো হলো:
১) ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকাঅধ্যাপক এ কে আজাদের মতে, অফিসকর্মীদের দীর্ঘ সময় বসে কাজ করতে হয়। ফলে মেটাবলিজম স্লো হয়ে যায়, ওজন বাড়ে, ইনসুলিন প্রতিরোধ তৈরি হয়।
২) অস্বাস্থ্যকর খাবার ও ফাস্টফুডব্যস্ততা, জাঙ্ক ফুড, কোমল পানীয়, অতিরিক্ত ক্যালরিযুক্ত খাবার, সব মিলিয়ে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বহুগুণ বাড়ায়। শিশুরাও এখন এই ঝুঁকিতে।
৩) হাঁটা ও ব্যায়ামের অভাবশহরে খোলা জায়গার অভাব, ব্যস্ততা এবং অলস লাইফস্টাইলের কারণে মানুষের প্রতিদিনের শারীরিক পরিশ্রম কমে গেছে।
৪) মানসিক চাপকর্মস্থলের চাপ, সময়ের অভাব ও প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ, সব মিলিয়ে শরীরের হরমোনাল ভারসাম্য নষ্ট হয়ে রক্তে শর্করা বাড়ে।
৫) ধূমপানগবেষণা বলছে, ধূমপায়ীদের টাইপ-২ ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি ৩০–৪০% বেশি।ই-সিগারেটও (ভ্যাপিং) সমান ক্ষতিকর,কারণ এতে থাকা নিকোটিন ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স বাড়ায় এবং ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণ কঠিন করে তোলে।
শিশু–কিশোরদের মধ্যেও ডায়াবেটিস বৃদ্ধিবাংলাদেশে ডায়াবেটিস রোগীর অন্তত ৪ লাখ শিশু-কিশোর, যাদের বেশির ভাগই টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। ফাস্টফুড, স্থূলতা, স্ক্রিন–টাইম বৃদ্ধি এবং শারীরিক খেলাধুলার অভাব, এগুলিই মূলত দায়ী।
ডায়াবেটিসের ভয়াবহ জটিলতাঅবহেলা করলে ডায়াবেটিস শুধু রক্তে শর্করা বাড়ায় না—এটি প্রভাব ফেলে:হৃদরোগস্ট্রোককিডনি বিকলচোখের রেটিনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে অন্ধত্বপায়ের সংক্রমণ ও অঙ্গহানিদাঁত ও মাড়ির রোগ (৬ষ্ঠ জটিলতা)এর কারণে বিশ্বে ২০২১ সালে ৬.৭ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
ধূমপান ত্যাগ কেন জরুরিধূমপান:ইনসুলিনকে দুর্বল করেরক্তে শর্করা বাড়ায়ইনসুলিনের বেশি ডোজ প্রয়োজন হয়হৃদরোগ, কিডনি ও চোখের ক্ষতি বাড়ায়ধূমপান বন্ধ করার ১২ ঘণ্টার মধ্যেই শরীরে ইতিবাচক পরিবর্তন শুরু হয়, রক্তে কার্বন মনোক্সাইড স্বাভাবিক হয়, দুই–তিন মাসে ফুসফুসের কার্যকারিতা বাড়ে, এক বছরে হৃদরোগের ঝুঁকি অর্ধেকে নেমে আসে।
ডায়াবেটিস প্রতিরোধে কী করতে হবেবিশেষজ্ঞদের মতে, নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনই ডায়াবেটিস প্রতিরোধের মূল চাবিকাঠি।
ডায়াবেটিস প্রতিরোধের কার্যকর উপায়প্রতিদিন ৩০–৪৫ মিনিট হাঁটাসপ্তাহে অন্তত ৩ দিন হালকা ব্যায়ামফাস্টফুড, জাঙ্ক ফুড ও অতিরিক্ত চিনি বর্জনওজন নিয়ন্ত্রণমানসিক চাপ কমানোধূমপান সম্পূর্ণ পরিত্যাগনিয়মিত ব্লাড সুগার, ওজন ও রক্তচাপ পরীক্ষাকর্মস্থলে সচেতনতা কেন গুরুত্বপূর্ণকারণ কর্মজীবী মানুষ দিনের বড় অংশ সময় কাটান অফিসে। তাই-কর্মীদের নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষাহাঁটার বিরতিহেলদি খাবারের ব্যবস্থাসচেতনতা প্রচারণামানসিক চাপ ব্যবস্থাপনাএসবই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ভূমিকা রাখে।[940]ডায়াবেটিস এখন নীরব মহামারি। কিন্তু এটি প্রতিরোধযোগ্য, যদি আমরা সচেতন হই, জীবনযাপনে পরিবর্তন আনি এবং ধূমপানসহ ঝুঁকিপূর্ণ অভ্যাস বর্জন করি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিরোধই সবচেয়ে বড় শক্তি। তাই আজকের এই বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবসে প্রতিজ্ঞা হোক, নিজে সচেতন হবো, পরিবার ও কর্মস্থলেও সচেতনতা ছড়িয়ে দেবো।