দক্ষিণ কোরিয়ার লেখক হান কাংয়ের লেখা `দ্যা ভেজেটারিয়ান` বইটি তাকে এনে দিয়েছে ২০২৪ সালের সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কার। কিন্তু কি এমন আছে এই বইয়ে? জানতে হলে বুক রিভিউ টি শেষ পর্যন্ত পড়ুন।
`দ্যা ভেজেটারিয়ান` এমন একটি উপন্যাস যা পাঠককে শুরুতেই নিয়ে যাবে গভীর এক ভাবনার জগতে। কোরীয় সমাজের পটভূমিতে রচিত এই উপন্যাসটি কেবল একজন নারীর খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের গল্প নয় বরং তার মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন, সামাজিক কাঠামো এবং ব্যক্তিগত স্বাধীনতার জটিল প্রশ্নগুলোকে সামনে আনে।
কাহিনি সংক্ষেপ:
গল্পের মূল চরিত্র ইয়ং-হে। শুরুতে তিনি একজন সাধারণ কোরিয়ান গৃহবধূ ছিলেন। স্বামী সংসার নিয়ে অতি সাধারণ একটা জীবন যাপন করতেন। যিনি হঠাৎ করে মাংস খাওয়া ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তার এই সিদ্ধান্তের পেছনে রয়েছে এক বিভীষিকাময় স্বপ্ন যা তার জীবনে গভীর প্রভাব ফেলে। কিন্তু তার মাংস খাওয়া বন্ধ করা যেন তার জীবনের সাধারণ কোনো পরিবর্তন নয় বরং তার ভেতরে চলতে থাকা মানসিক এবং শারীরিক বিদ্রোহের প্রতিচ্ছবি। তার এই সিদ্ধান্তের পর থেকেই শুরু হয় অশান্তি।
তার স্বামী, পরিবার এবং সমাজ তার এই আচরণকে অদ্ভুত এবং অস্বাভাবিক বলেই মনে করে। যা ধীরে ধীরে সহিংসতার দিকে মোড় নেয়। একবার তো তার বাবা তাকে শুকরের মাংস খেতে জোড়াজুড়ি করায় সে তার নিজের হাতে ছুরি বসিয়ে দেয়। তার এই অস্বাভাবিক পরিবর্তনের কারনে পরিবারের সবার মধ্যকার সম্পর্কগুলোতে ভাঙন শুরু হয় এবং সমাজের চলমান নিয়মকানুন গুলো প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
উপন্যাসের গঠন ও চরিত্রের বিবর্তন:
"দ্যা ভেজেটারিয়ান" তিনটি ভাগে বিভক্ত। প্রথম অংশে ইয়ং-হে-র স্বামীর দৃষ্টিকোণ থেকে তার পরিবর্তনকে দেখা হয়। যেখানে তার স্বামী মি. চিয়ং তাকে কেবল এক সাধারণ এবং "অবাধ্য" স্ত্রী হিসেবে বিচার করে। দ্বিতীয় অংশে ইয়ং-হে-র বোনের জামাইয়ের দৃষ্টিভঙ্গি দেখানো হয়। যিনি একজন ব্যর্থ শিল্পী কিন্তু সে ইয়ং হে-র প্রতি শারীরিক এবং মানসিক আকর্ষণ অনুভব করে। তৃতীয় অংশে ইয়ং-হে-র বোন ইন-হাই-এর দৃষ্টিকোণ থেকে তার জীবন এবং পরিবারের ভাঙনের দৃশ্য উঠে আসে।
এই ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণগুলো গল্পের গভীরতাকে বাড়িয়ে দেয় এবং পাঠককে ভাবতে বাধ্য করে—আসলে কে সঠিক? আর কারই বা মানসিক অবস্থা বিকৃত? প্রতিটি চরিত্রের আচরণের পেছনে কারণ ছিলো তাদের নিজস্ব দ্বন্দ্ব এবং ব্যক্তিগত সংগ্রাম। যেগুলো উপন্যাসে সুন্দর করে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
`দ্যা ভেজেটারিয়ান` উপন্যাসের থিম
"দ্যা ভেজেটারিয়ান" বইটির মূল থিম হলো ব্যক্তিগত স্বাধীনতা, ইচ্ছাশক্তি এবং সমাজের রীতিনীতির বিরুদ্ধে লড়াই। ইয়ং-হে-এর নিরামিষভোজী হয়ে ওঠা যেন তার নিজের শরীরের ওপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা। এটি সমাজের বিধিনিষেধের বিরুদ্ধে এক অদৃশ্য বিদ্রোহ, যা তার স্বামী ও পরিবারের মধ্যে অস্থিরতা সৃষ্টি করে।
হান কাং এই উপন্যাসের মাধ্যমে নারীর শরীর ও ব্যক্তিস্বাধীনতার বিষয়ে প্রশ্ন তোলেন। একজন নারী তার ইচ্ছা অনুযায়ী নিজের শরীরের ওপর কতটা অধিকার রাখতে পারেন? কিংবা সমাজ এবং পারিবারিক দায়িত্ববোধের নিচে চাপা পড়ে থাকা ইচ্ছাগুলো কি প্রকৃত স্বাধীনতা লাভ করতে পারে?
লেখার ধরন ও ভাষার গুণাবলি:
হান কাং-এর লেখার ধরন অত্যন্ত সরল, তবে এর গভীরতা পাঠককে মুগ্ধ করে। তার ভাষা একদিকে তীক্ষ্ণ, অন্যদিকে আবেগপূর্ণ। উপন্যাসের ধীরগতি এবং প্রতিটি চরিত্রের দৃষ্টিকোণ পাঠককে চিন্তার গভীরে নিয়ে যায়। লেখকের বর্ণনা এবং কাহিনির নির্মাণশৈলী এমন যে, পাঠক প্রতিটি বাক্যেই একটি অস্বস্তিকর অনুভূতি অনুভব করে যা উপন্যাসের থিমের সঙ্গে অত্যন্ত সামঞ্জস্যপূর্ণ।
উপসংহার:
"দ্যা ভেজেটারিয়ান" এমন একটি উপন্যাস, যা কেবল এক নারীর ব্যক্তিগত বিদ্রোহের গল্প নয়। বরং এটি মানুষের স্বাধীনতার খোঁজ, আত্মপরিচয়ের লড়াই এবং সামাজিক কাঠামোর বিরুদ্ধে এক অদৃশ্য সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি। হান কাং-এর এই সাহিত্যকর্ম একদিকে সমাজের প্রতিনিয়ত চাপানো নিয়ম-কানুনের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত স্বাধীনতার চাহিদাকে তুলে ধরে, অন্যদিকে সম্পর্কের টানাপোড়েনের জটিলতাকে সামনে আনে। পাঠকদের মনে গভীর ভাবনার জন্ম দেয় এই উপন্যাস।
আপনার মতামত লিখুন :