গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী এর হামলায় নিহত হন হামাসের শীর্ষ নেতা ইয়াহিয়া সিনওয়ার। ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী (আইডিএফ) এবং গোয়েন্দা সংস্থা শিন বেত যৌথভাবে এই অভিযানের নেতৃত্ব দেয়। ইসরায়েলি কর্মকর্তারা সিনওয়ারকে ৭ অক্টোবর ২০২৩ সালে ইসরায়েলে চালানো হামলার মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে অভিযুক্ত করেছিলেন। সেই হামলায় হামাস যোদ্ধারা ১,২০০ ইসরায়েলি নাগরিককে হত্যা করে এবং ২৫১ জনকে জিম্মি করে নিয়ে যায়।
ইয়াহিয়া সিনওয়ার হত্যার অভিযান
বুধবার, ১৬ অক্টোবর ২০২৪, গাজার দক্ষিণে রাফাহ শহরে এক ইসরায়েলি সামরিক অভিযানে ইয়াহিয়া সিনওয়ারকে হত্যা করা হয়। ইসরায়েলের আইডিএফের মতে, অভিযানে তিনজন বন্দুকধারী নিহত হয়, তাদের মধ্যে একজন ছিলেন সিনওয়ার। তবে অভিযানের সময় কোনো জিম্মিকে পাওয়া যায়নি, গুঞ্জন ছিল সিনওয়ার জিম্মিদের মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করতেন। অভিযানের পর সিনওয়ারের দেহ শনাক্ত করতে কয়েক ঘণ্টা সময় লাগে। কেননা ইসরায়েলি সেনাবাহিনী তার দেহের ডিএনএ এবং দাঁতের রেকর্ড মিলিয়ে এরপর তার মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করে।
অভিযানে ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া
ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসরায়েল কাটজ এই ঘটনাকে "ইসরায়েলের জন্য বড় সামরিক ও নৈতিক সফলতা" হিসেবে উল্লেখ করেন। তিনি আরও বলেন, সিনওয়ারের মৃত্যু উগ্রপন্থী ইসলামের বিপক্ষে বিশ্বের মুক্ত শক্তির বিজয়ের প্রতীক। তিনি দীর্ঘদিন গাজায় আত্মগোপনে ছিলেন, ফলে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী এক বছর ধরে সিনওয়ারকে হত্যা করার পরিকল্পনা করে আসছিল। সিনওয়ারের মৃত্যুতে হামাসের জিম্মি পরিস্থিতির পরিবর্তন হতে পারে বলেও আশা করা হচ্ছে।
হামাসের জন্য বড় আঘাত
হামাসের জন্য সিনওয়ারের মৃত্যু একটি বড় ধাক্কা হিসেবে দেখা হচ্ছে। গত কয়েক মাস আগেই হামাসের সাবেক প্রধান ইসমাইল হানিয়াকে হত্যা করেছিল ইসরায়েল। ইসমাইল হানিয়ার মৃত্যুর পর সিনওয়ার হামাসের প্রধান হন এবং সংগঠনের নেতৃত্বে আসে পরিবর্তন। পর পর দুই নেতার মৃত্যুতে হামাসের আভ্যন্তরীণ নেতৃত্বের কাঠামো ইতোমধ্যেই দুর্বল হয়ে পড়েছে, ফলে হামাসকে পুনর্গঠনের প্রয়োজন দেখা দিতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
নেতৃত্বহীন হামাসের ভবিষ্যৎ
কাতারের দোহা ইনস্টিটিউট ফর গ্র্যাজুয়েট স্টাডিজের অধ্যাপক মোহাম্মদ এলমাসরি আল-জাজিরাকে বলেন, সিনওয়ারের মৃত্যু হামাসের জন্য একটি নতুন চ্যালেঞ্জ। সংগঠনটি ইতোমধ্যেই নেতৃত্ব সংকটে রয়েছে এবং সিনওয়ারকে হারানোর পর তাদের নেতৃত্ব পুনর্গঠনের প্রয়োজন হবে। সিনওয়ার দীর্ঘদিন ইসরায়েলের কারাগারে ছিলেন এবং ২০১১ সালে বন্দি বিনিময়ের আওতায় মুক্তি পান। তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে হামাসের সামরিক নেতৃত্ব এক বড় ধাক্কা খেল।
হত্যা অভিযানে আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
ইসরায়েলের এই সামরিক অভিযান এবং সিনওয়ারের মৃত্যুর পর আন্তর্জাতিক মহলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের এই অভিযানকে সমর্থন জানিয়েছে, তবে গাজায় ত্রাণ প্রবেশের অনুমতি দেয়া নিয়ে ইসরায়েলের ওপর চাপ তৈরি হয়েছে। ইসরায়েল প্রায় দুই সপ্তাহ গাজার জন্য ত্রাণ প্রবেশ বন্ধ করে রেখেছিল। এতে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিকভাবে ক্ষুধাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা গাজায় মানবিক সংকটের আশঙ্কা প্রকাশ করেছে এবং দ্রুত ত্রাণ প্রবেশের দাবি জানিয়েছে।
গাজার মানবিক পরিস্থিতি
জাতিসংঘের ফিলিস্তিনিদের জন্য ত্রাণ ও কর্মসংস্থান বিষয়ক সংস্থা (ইউএনআরডব্লিউএ) সতর্ক করেছে যে, গাজায় প্রকৃত অর্থে দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে। গাজায় প্রতিদিন ৩৫০ ট্রাক ত্রাণের প্রয়োজন থাকলেও ইসরায়েল মাত্র ৫০ ট্রাক প্রবেশের অনুমতি দিয়েছে। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, গাজার পরিস্থিতি ক্রমশই বিপজ্জনক হয়ে উঠছে এবং সেখানে মারাত্মক অপুষ্টি ও দুর্ভিক্ষের ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।
ইসরায়েল ও লেবানন সীমান্তে উত্তেজনা
ইসরায়েল ও লেবাননের সীমান্তেও উত্তেজনা বাড়ছে। হিজবুল্লাহ ইসরায়েলের দুটি ট্যাংক ধ্বংসের দাবি করেছে। লেবাননের টায়রে ও বেকা অঞ্চলে ইসরায়েল নতুন করে বিমান হামলা চালিয়েছে এবং সেখানকার বাসিন্দাদের বাড়ি ছেড়ে যেতে নির্দেশ দিয়েছে। হিজবুল্লাহ জানিয়েছে, তারা গাইডেড মিসাইল ব্যবহার করে ইসরায়েলের ট্যাংক ধ্বংস করেছে। সীমান্ত এলাকায় লড়াই অব্যাহত রয়েছে এবং পরিস্থিতি ক্রমশই জটিল হয়ে উঠছে।
উপসংহার
ইয়াহিয়া সিনওয়ারের মৃত্যু ইসরায়েলের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য সামরিক সাফল্য হিসেবে দেখা হলেও এটি হামাসের জন্য এক বড় ধাক্কা। হামাসের নেতৃত্বের কাঠামো ভেঙে পড়েছে এবং সংগঠনটির ভবিষ্যৎ এখন পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার ওপর নির্ভর করছে। একই সময়ে গাজায় মানবিক সংকটের সম্ভাবনা ক্রমশই বাড়ছে, যা আন্তর্জাতিক মহলেরও দৃষ্টি আকর্ষন করেছে।
আপনার মতামত লিখুন :