বাংলাদেশ শনিবার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২৪, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

কয়লার বাড়তি মূল্য ও বকেয়া বিল দাবি আদানির, বাংলাদেশে বিদ্যুৎ বন্ধের হুমকি

দৈনিক প্রথম সংবাদ ডেস্ক

প্রকাশিত: নভেম্বর ১, ২০২৪, ১০:২৪ এএম

কয়লার বাড়তি মূল্য ও বকেয়া বিল দাবি আদানির, বাংলাদেশে বিদ্যুৎ বন্ধের হুমকি

ছবি: সংগৃহীত

সম্প্রতি ভারতীয় আদানি গ্রুপের বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কেনার চুক্তি নিয়ে বাংলাদেশে নানা জটিলতা এবং আর্থিক চাপের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ব্যবহার করা কয়লার দামে সাম্প্রতিক বৃদ্ধি এবং বকেয়া পরিশোধ নিয়ে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) এর সঙ্গে বিরোধ শুরু হয়। আদানি গত জুলাই থেকে বিদ্যুতের জন্য অতিরিক্ত চার্জ দাবি করছে এবং বকেয়া বিল পরিশোধে পিডিবিকে চাপ দিচ্ছে। ইতিমধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমিয়ে অর্ধেকের নিচে এনেছে আদানি। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন আদানি একতরফা চুক্তির সুযোগ নিচ্ছে।

আদানি বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে চুক্তি

ভারতের ঝাড়খন্ড রাজ্যের গোড্ডায় অবস্থিত আদানি বিদ্যুৎকেন্দ্রটি থেকে বাংলাদেশ গত বছর বিদ্যুৎ কেনা শুরু করে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের আগেই কয়লার দাম নিয়ে মতবিরোধ দেখা দেয়। প্রথমে পিডিবি চড়া দামে কয়লা কেনায় আপত্তি জানালে আদানি তখন কিছুটা ছাড় দেয়। তারা পায়রা ও রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের তুলনায় কম দামে কয়লা সরবরাহের প্রতিশ্রুতিও দেয়। কিন্তু এক বছর যেতে না যেতেই আদানি আবারও ২২ শতাংশ বাড়তি দাম দাবি করে।

সাম্প্রতিক বকেয়া ও বাড়তি দাম নিয়ে বিরোধ

বাড়তি দাম এবং বকেয়া পরিশোধ নিয়ে আদানি ২৮ অক্টোবর পিডিবিকে চিঠি দিয়ে জানায়, ৩০ অক্টোবরের মধ্যে বকেয়া না পেলে ৩১ অক্টোবর থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখতে বাধ্য হবে। এর পেছনে তাদের চলতি মূলধনের সংকট একটি কারণ বলে দাবি করছে আদানি। তবে পিডিবি এ বিষয়ে সময় চাওয়ায় আদানি একটি ইউনিট বন্ধ করে উৎপাদন সীমিত করে দিয়েছে।

কয়লার দাম নির্ধারণ ও আদানির দাবি

পিডিবি জানিয়েছে, পটুয়াখালীর পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রতি টন কয়লার দাম ৭৫ ডলার এবং রামপাল ও বাঁশখালীতে ৮০ ডলারের কম। কিন্তু আদানি ৯৬ ডলার চাচ্ছে, যা অন্যান্য বিদ্যুৎকেন্দ্রের তুলনায় ২১-১৬ ডলার বেশি। এ বিষয়ে আদানি বলছে, তারা কয়লার প্রাইস ইনডেক্স অনুসারে বিল করছে এবং কোনো পরিবর্তন করেনি।

বকেয়া বিল ও আন্তর্জাতিক সূচক

বিদ্যুৎ বিভাগ ও পিডিবির কর্মকর্তারা জানান, আদানির প্রতি সপ্তাহের বিল প্রায় ২.২-২.৫ কোটি ডলার। কিন্তু পিডিবি পরিশোধ করছে প্রায় ১.৮ কোটি ডলার। ফলে অক্টোবর পর্যন্ত আদানির পাওনা প্রায় ৮৫ কোটি ডলারে পৌঁছেছে। আদানির দাবি আন্তর্জাতিক সূচক অনুযায়ী কয়লার দাম হিসাব করা হচ্ছে। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন তাদের নির্দিষ্ট ছাড়ের পর কয়লার প্রকৃত দাম আরও কম হওয়া উচিত ছিল।

চুক্তির একতরফা সুবিধা ও পিডিবির মতামত

চুক্তিতে আদানি বাড়তি সুবিধা পেয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। তারা কয়লার দাম নির্ধারণে ইন্দোনেশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ার সূচকের গড় ধরায় পিডিবির ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। আদানি বিশেষ ছাড়ে কয়লা কিনলেও সেই সুবিধা পিডিবি পাচ্ছে না। পিডিবি বলছে, আদানির কয়লার গড় মানের তুলনায় যে দাম ধরেছে তা ২০-২৫ ডলার কম হলে বাস্তবসম্মত হবে।

পিডিবির দাবি ও আদানির প্রত্যাখ্যান

পিডিবির একজন কর্মকর্তা উদাহরণ দিয়ে বলেন এটি ইলিশ মাছের দামের মতো বিষয়। এক কেজি ইলিশের বাজারদর দিয়ে যদি ৭০০ গ্রাম ইলিশের দাম নির্ধারণ করা হয় তবে সেটি অযৌক্তিক। আদানি এই ভুল হিসাব অনুসারে কয়লার দাম চাচ্ছে। আদানি অবশ্য এই দাবিকে নাকচ করে বলছে কয়লার ক্যালরিফিক ভ্যালু অনুযায়ী দাম নির্ধারণ করা হচ্ছে।

চুক্তি পর্যালোচনা ও বিশেষ বিধানের সুযোগ

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন বাড়তি দাম পরিশোধের প্রয়োজন নেই। চুক্তির শর্তাবলি আন্তর্জাতিক নিয়মে নিরপেক্ষভাবে পর্যালোচনা করা হবে। ইতিমধ্যে চুক্তি পর্যালোচনা কমিটি কাজ শুরু করেছে।

২০১০ সালে করা দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০২১ সালে সংশোধিত হয়। যেখানে চুক্তিগুলোর দায়মুক্তি রয়েছে এবং আদালতে যাওয়ার সুযোগ নেই। জাতীয় পর্যালোচনা কমিটি আদানি বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ ১১টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের কাজ করছে।

আদানির অতিরিক্ত সুবিধা ও জাতীয় স্বার্থ পর্যালোচনার দাবি

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, আদানির সঙ্গে চুক্তিতে অনেক বাড়তি খরচ ধরা হয়েছে এবং তারা পদে পদে সুবিধা নিয়েছে। তাদের কন্ট্রাক্টে ১৫ শতাংশ চড়া সুদ, আনুসাঙ্গিক সব খরচের দায় পিডিবির ওপর। এছাড়াও তারা পানি ব্যবহারের খরচ যুক্ত করেছে যা পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রে নেই। অন্যদিকে আদানির কেন্দ্রে বিনিয়োগের সুদের হার ভারত নির্ধারণ করবে।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) উপদেষ্টা এম শামসুল আলম বলেন, এ চুক্তিতে একতরফা সুবিধা নিচ্ছে আদানি। জাতীয় স্বার্থে এ চুক্তি পর্যালোচনা করা উচিত এবং প্রয়োজনে আদালতে যাওয়ার কথা ভাবছে ক্যাব।

 

Link copied!

সর্বশেষ :