মুসলিম উম্মাহর ইবাদত, আত্মশুদ্ধি এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মাস রমজান। এই মাসের ফজিলত ও বরকত লাভের জন্য রাসুলুল্লাহ (সাঃ) রমজানের আগে থেকেই নিতেন বিশেষ প্রস্তুতি। তাঁর সুন্নাহ অনুসরণ করে আমরা কীভাবে মাহে রমজানের প্রস্তুতি নিতে পারি, তা নিচে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
১. একনিষ্ঠভাবে তওবা ও আত্মশুদ্ধি
রমজানের প্রস্তুতির প্রথম ধাপ হলো নিজের পাপ থেকে মুক্তি পেতে আল্লাহর কাছে আন্তরিকভাবে তওবা করা। তওবা পবিত্রতার দরজা খুলে দেয় এবং ইবাদতে মনোযোগী হতে সাহায্য করে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন: “হে লোকেরা, তোমরা আল্লাহর কাছে তওবা করো। আমি প্রতিদিন আল্লাহর কাছে একশ বার তওবা করি।” (মুসলিম: ২৭০২)
২. আল্লাহর কাছে দোয়া করা
রমজানের আগমনের জন্য এবং তাতে সাফল্যের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করা উচিত। রাসুলুল্লাহ (সা.) রমজানে পৌঁছার জন্য বিশেষ দোয়া করতেন: “হে আল্লাহ, আমাদের জন্য রজব ও শাবান মাস বরকতময় করুন এবং আমাদের রমজান পর্যন্ত পৌঁছে দিন।” (তাবারানি: ৩৯৩৯)
আমরা দোয়া করতে পারি:
- শারীরিক সুস্থতার জন্য।
- রমজানে নেক আমল করার জন্য।
- আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য।
৩. শাবান মাসে নফল রোজা রাখা
শাবান মাসে রোজা রাখা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর গুরুত্বপূর্ণ একটি সুন্নাহ। এটি আত্মাকে রমজানের দীর্ঘ রোজার জন্য প্রস্তুত করে। আয়েশা (রা.) বলেন: “আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে রমজান ছাড়া অন্য কোনো মাসে এত বেশি রোজা রাখতে দেখিনি, যেমন শাবান মাসে দেখেছি।” (বুখারি: ১৮৬৮)
উসামা ইবনে যায়েদ (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: “শাবান হলো এমন একটি মাস, যখন মানুষ গাফেল থাকে। এই মাসে আমলগুলো আল্লাহর কাছে তোলা হয়। আমি চাই, আমার আমল উত্তোলিত হোক, যখন আমি রোজাদার থাকি।” (নাসাঈ: ২৩৫৭)
৪. বাকি থাকা রোজা কাজা করা
যদি পূর্ববর্তী রমজানের কোনো রোজা কাজা করা বাকি থাকে, তাহলে তা শাবান মাসের মধ্যেই আদায় করা জরুরি। আয়েশা (রা.) বলেন:
“আমার উপর বিগত রমজানের রোজা বাকি থাকলে, আমি শাবান মাসে তা কাজা আদায় করতাম।” (বুখারি: ১৮৪৯; মুসলিম: ১১৪৬)
কাজা রোজা রেখে আল্লাহর হুকুম পূর্ণ করা ওয়াজিব। তাই রমজান শুরু হওয়ার আগে এই দায়িত্ব পালন করা উচিত।
৫. রমজানের আসন্ন আগমনে খুশি হওয়া
রমজান মাসের আগমন একজন মুসলিমের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি বড় নেয়ামত। কারণ এই মাসে রহমত, বরকত এবং গুনাহ মাফের দরজা খুলে দেওয়া হয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন: “বলুন, এটি আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়ায়। এতে তারা আনন্দিত হোক। এটি তাদের সঞ্চিত সম্পদের চেয়ে উত্তম।” (সূরা ইউনুস: ৫৮)
৬. রোজার মাসায়েল ও বিধান জানা
রমজানের ফজিলত ও বিধান সম্পর্কে জানা অত্যন্ত জরুরি। রোজার নিয়ম, ভঙ্গের কারণ, ইফতার ও সাহরির সঠিক পদ্ধতি, তারাবি, ইতিকাফ ও সদকাতুল ফিতর সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান অর্জন করলে রমজানের ইবাদত আরও সুন্দরভাবে পালন করা সম্ভব।
৭. ইবাদতে প্রতিবন্ধকতা দূর করা
- রমজানে ইবাদতের জন্য আগেই নিজের ব্যস্ততাগুলো কমানো উচিত।
- ব্যবসা-বাণিজ্য বা অফিসের কাজগুলো পরিকল্পনা করে আগেই সম্পন্ন করুন।
- অপ্রয়োজনীয় কাজ বাদ দিন, যাতে ইবাদতে পূর্ণ মনোযোগ দেওয়া যায়।
৮. পরিবারের সঙ্গে রমজানের আলোচনা করা
- পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে রমজানের ফজিলত ও ইবাদতের গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করুন।
- ছোটদের রোজার গুরুত্ব বোঝান এবং তাদের রোজা রাখতে উৎসাহ দিন।
- পরিবারের সবাইকে একসঙ্গে ইবাদতে অংশগ্রহণ করান।
৯. দান-খয়রাতের পরিকল্পনা করা
রমজানে দান-খয়রাতের সওয়াব বহুগুণ বৃদ্ধি করা হয়। তাই রমজানের আগেই দানের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া উচিত।
- ফকির-মিসকিনদের জন্য সাহায্যের ব্যবস্থা করুন।
- মসজিদ ও মাদ্রাসায় সাহায্য করার পরিকল্পনা করুন।
১০. কুরআন তিলাওয়াত শুরু করা
রমজানে কুরআন খতমের প্রস্তুতি হিসেবে শাবান মাস থেকেই তিলাওয়াতের অভ্যাস গড়ে তোলা উচিত।
আবু বকর আল-বালখী (রহ.) বলেছেন: “রজব হলো বীজ বপনের মাস, শাবান হলো সেচ দেওয়ার মাস এবং রমজান হলো ফসল কাটার মাস।” এটি রমজানে ইবাদতে আরও মনোযোগী হতে সাহায্য করে।
উপসংহার
রমজান আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি বিশেষ নেয়ামত, যেখানে প্রতিটি আমলের সওয়াব বহুগুণ বাড়িয়ে দেওয়া হয়। এ মাসের বরকত অর্জনের জন্য রজব ও শাবান মাস থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সুন্নাহ অনুসারে প্রস্তুতি গ্রহণ করলে আমরা রমজানের মূল উদ্দেশ্য, অর্থাৎ তাকওয়া অর্জন এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে সক্ষম হব।
আপনার মতামত লিখুন :