বাংলাদেশ সোমবার, ১৭ মার্চ, ২০২৫, ৩ চৈত্র ১৪৩১

জাতীয় নাগরিক পার্টির আত্মপ্রকাশ সেকেন্ড রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার

দৈনিক প্রথম সংবাদ ডেস্ক

প্রকাশিত: মার্চ ১, ২০২৫, ১২:৩২ পিএম

জাতীয় নাগরিক পার্টির আত্মপ্রকাশ সেকেন্ড রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার

">

 বাংলাদেশে নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) আত্মপ্রকাশ করেছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে উঠে আসা এই দলটি দেশের জন্য ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করার ঘোষণা দিয়েছে। দলটির আহ্বায়ক মো. নাহিদ ইসলাম বলেছেন, তাঁদের প্রধান লক্ষ্য হবে গণপরিষদ নির্বাচন আয়োজন করে একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন

রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে দলটির মূল লক্ষ্য, নীতি ও পরিকল্পনা তুলে ধরা হয়। নাহিদ ইসলাম বলেন, "জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দীর্ঘ দেড় দশকের স্বৈরাচারী শাসনের পতন ঘটেছে, কিন্তু কেবল সরকারের পরিবর্তন যথেষ্ট নয়। আমাদের প্রয়োজন রাষ্ট্রের রাজনৈতিক কাঠামোর আমূল সংস্কার।"


জাতীয় নাগরিক পার্টি তাদের ঘোষণায় ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ ধারণার ব্যাখ্যা দিয়েছে। দলটি মনে করে, বর্তমান সংবিধান রাষ্ট্রের জনগণের প্রকৃত ক্ষমতায়নের পরিবর্তে ক্ষমতার এককেন্দ্রীকরণ ঘটিয়েছে। ফলে প্রশাসন, আইনসভা ও বিচার বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়েছে। এনসিপি মনে করে, একটি নতুন সংবিধানের মাধ্যমে জনগণের প্রত্যক্ষ ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

নাহিদ ইসলাম বলেন, "আমরা এমন একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা চাই, যেখানে রাষ্ট্রের মালিকানা থাকবে জনগণের হাতে। জনগণই হবে সর্বময় ক্ষমতার উৎস।"


জাতীয় নাগরিক পার্টির মূল লক্ষ্য ও পরিকল্পনা

জাতীয় নাগরিক পার্টি বিশ্বাস করে, বর্তমান সংবিধানে মৌলিক সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে। দলটি গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন করার উদ্যোগ নেবে। এর মাধ্যমে— রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য আনা হবে।বিচার বিভাগ, প্রশাসন ও আইনসভার মধ্যে ক্ষমতার পৃথকীকরণ নিশ্চিত করা হবে রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র বাধ্যতামূলক করা হবে।

দলটি মনে করে, কেন্দ্রীয় শাসনের পরিবর্তে স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করতে হবে। এর মাধ্যমে— উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের প্রশাসনকে স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হবে। স্থানীয় জনগণের সরাসরি অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হবে।

জাতীয় নাগরিক পার্টির আত্মপ্রকাশ সেকেন্ড রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার
জাতীয় নাগরিক পার্টির আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানমঞ্চে বক্তব্য দেন দলের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে

 অর্থনৈতিক নীতি ও পরিকল্পনা

  • জাতীয় নাগরিক পার্টি একটি স্বনির্ভর, টেকসই এবং বৈষম্যহীন অর্থনীতি গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

  •  কৃষি, শিল্প ও প্রযুক্তি খাতের সমন্বয় ঘটানো হবে।

  •  বৈষম্য দূর করতে সম্পদের সুষম পুনর্বণ্টন করা হবে।

  •  ব্যবসায়িক সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

  •  বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ বাড়িয়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করা হবে।

৪. সামাজিক ন্যায়বিচার ও মানবাধিকার সুরক্ষা

  •  সংখ্যালঘু, নারীদের অধিকার এবং শ্রমজীবী মানুষের সুরক্ষায় আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা হবে।

  •  স্বাস্থ্য ও শিক্ষাকে সবার জন্য সহজলভ্য করা হবে।

  •  নারীর ক্ষমতায়ন, জেন্ডার সমতা এবং শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করা হবে।


জাতীয় নাগরিক পার্টির প্রতিশ্রুত রাজনৈতিক সংস্কৃতি

দলটি বলছে, বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক ব্যবস্থায় পরিবারতন্ত্র, স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি এবং দলীয়করণ প্রাধান্য পেয়েছে। তাই তারা এমন একটি সংস্কৃতি গড়ে তুলতে চায় যেখানে—

  •  বিভেদের বদলে ঐক্য, প্রতিশোধের বদলে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে।

  •  রাজনীতিতে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির কোনো স্থান থাকবে না।

  •  পারিবারিক রাজনীতির পরিবর্তে মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে নেতৃত্ব নির্বাচন করা হবে


সেকেন্ড রিপাবলিক: চ্যালেঞ্জ ও সমালোচনা

জাতীয় নাগরিক পার্টির ঘোষিত লক্ষ্য ও পরিকল্পনা যথেষ্ট উচ্চাভিলাষী এবং সময়সাপেক্ষ। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, নতুন সংবিধান প্রণয়নের মতো বড় পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করা সহজ হবে না

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. মাহমুদুর রহমান বলেন, "বাংলাদেশের সংবিধান পরিবর্তন করতে হলে বিরোধী দলগুলোর সমর্থন প্রয়োজন। জাতীয় নাগরিক পার্টি যদি শক্তিশালী গণআন্দোলন গড়ে তুলতে না পারে, তাহলে তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না।"

অন্যদিকে, প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলো এনসিপির দাবির সমালোচনা করেছে। ক্ষমতাসীন দলের এক নেতা বলেছেন, "দেশে সংবিধান পরিবর্তনের কোনো প্রয়োজন নেই। জাতীয় নাগরিক পার্টি রাজনৈতিক বিভ্রান্তি তৈরি করতে চাইছে।"

তবে এনসিপির নেতারা বলছেন, তারা জনগণের সমর্থন নিয়েই এগিয়ে যাবেন। নাহিদ ইসলাম বলেন, “আমরা রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে সচেতন। তবে জনগণের ইচ্ছাই আমাদের একমাত্র শক্তি।”

জাতীয় নাগরিক পার্টির আত্মপ্রকাশের পর থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। কেউ কেউ দলটির সাহসী উদ্যোগের প্রশংসা করেছেন, আবার অনেকে তাদের পরিকল্পনাকে অবাস্তব বলে মনে করছেন।

জাতীয় নাগরিক পার্টির আত্মপ্রকাশ সেকেন্ড রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার
জাতীয় নাগরিক পার্টির আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গতকাল শুক্রবার রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে দলে দলে হাজির হন সমর্থকেরা

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, “জাতীয় নাগরিক পার্টি যদি কার্যকর রাজনৈতিক কর্মসূচি দিতে পারে, তাহলে তারা তরুণ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে জনপ্রিয়তা পেতে পারে। তবে বাস্তবায়নযোগ্য নীতি ও সংগঠন গড়ে না তুললে তারা টিকে থাকতে পারবে না।”

জাতীয় নাগরিক পার্টির আত্মপ্রকাশ বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে। ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ ধারণা কতটা বাস্তবায়নযোগ্য হবে, সেটি নির্ভর করবে দলটির সাংগঠনিক দক্ষতা, জনসমর্থন এবং রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার সক্ষমতার ওপর।

নাহিদ ইসলাম ও তাঁর দল নতুন সংবিধান প্রণয়ন, অর্থনৈতিক সংস্কার এবং সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার অঙ্গীকার করেছেন। তবে তাদের রাজনৈতিক লড়াই কতটা সফল হবে, সেটিই এখন দেখার বিষয়।

আপনার মতামত লিখুন :

Link copied!

সর্বশেষ :