আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, সাবেক কৃষিমন্ত্রী এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ‘অগ্নিকন্যা’ খ্যাত বেগম মতিয়া চৌধুরী আর নেই। আজ ১৬ অক্টোবর দুপুর ১২টায় রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮২ বছর।
মতিয়া চৌধুরী দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ ছিলেন এবং এক সপ্তাহ আগে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর বাসায় ফিরেছিলেন। তবে শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাকে আবার হাসপাতালে নেওয়া হয় এবং সেখানেই তার মৃত্যু হয়। তার সাবেক একান্ত সচিব মো. শাহজালাল এই তথ্য জানান।
প্রভাবশালী রাজনৈতিক জীবন
মতিয়া চৌধুরী ছয়বার শেরপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৯৬, ২০০৯, এবং ২০১৩ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের কৃষিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৩ সালে তিনি জাতীয় সংসদের উপনেতা হিসেবে মনোনীত হন। তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের প্রতিটি অধ্যায় ছিল সংগ্রামের। যার জন্য তাকে ‘অগ্নিকন্যা’ বলা হতো।
১৯৪২ সালের ৩০ জুন পিরোজপুরে জন্মগ্রহণকারী মতিয়া চৌধুরীর বাবা মহিউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা এবং মা নুরজাহান বেগম গৃহিণী। ইডেন কলেজে পড়াশোনা চলাকালীন তিনি ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৬১-৬২ শিক্ষাবর্ষে তিনি ইডেন কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি ছিলেন। পরে ১৯৬৫ সালে তিনি ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি হন।
`অগ্নিকন্যা`র উত্থান
বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রামে তার ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করার কারণে মতিয়া চৌধুরী বিশেষভাবে পরিচিত হন। তার আগুনঝরা ভাষণ এবং সাহসী ভূমিকার কারণে তিনি ‘অগ্নিকন্যা’ নামে পরিচিতি লাভ করেন।
১৯৬৭ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে যোগ দেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন তিনি ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ গেরিলা বাহিনীর একজন সংগঠক হিসেবে কাজ করেন। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ১৯৭৯ সালে তিনি ন্যাপ থেকে আওয়ামী লীগে যোগ দেন এবং দলটির গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হন।
সংগ্রাম এবং কারাবাস
দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে মতিয়া চৌধুরী বারবার গ্রেপ্তার হন এবং জেলেও কাটিয়েছেন। তার জেলজীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি একটি বইও লিখেছেন, যার নাম "দেয়াল দিয়ে ঘেরা"। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এবং এরশাদের শাসনামলে তিনি ১৫ বার গ্রেপ্তার হন এবং টানা দুই বছর জেলও খেটেছেন।
রাজনৈতিক দায়িত্ব ও অবদান
মতিয়া চৌধুরী তিনবার মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে তিনি কৃষি, খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন। পরবর্তী দুটি মন্ত্রণালয়েও তার দক্ষ নেতৃত্বের জন্য তিনি প্রশংসিত হন। ২০২৩ সালে তিনি সংসদ উপনেতার দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
তার কর্মজীবনে অসাধারণ অবদানের জন্য ২০২১ সালে বাংলা একাডেমি তাকে সম্মানসূচক ফেলোশিপ প্রদান করে।
সাধারণ জীবনযাপন
মতিয়া চৌধুরী তার সাদামাটা জীবনযাপন এবং সাধারণ বেশভূষার জন্য পরিচিত ছিলেন। তার রাজনৈতিক সহকর্মীরা তাকে একজন নির্ভীক এবং সৎ নেতা হিসেবে শ্রদ্ধা করতেন। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তিনি সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করে গেছেন এবং রাজনৈতিক সংগ্রামে অবিচল থেকেছেন।
সমাপ্তি
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে মতিয়া চৌধুরীর অবদান অমলিন থাকবে। তিনি ছিলেন একাধারে সংগ্রামী, নির্ভীক, এবং মানুষের নেতা। যিনি সারা জীবন সাধারণ মানুষের কল্যাণে কাজ করেছেন।
আপনার মতামত লিখুন :