বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর জন্য ২০২৫ সাল এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। দীর্ঘ ১৬ বছর পর দলটি কক্সবাজারে প্রকাশ্যে কর্মী সম্মেলন আয়োজন করতে সক্ষম হয়েছে, যা রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়। শনিবার (৮ ফেব্রুয়ারি) সকাল ৯টায় কক্সবাজার জেলা শাখার আয়োজনে শুরু হওয়া এই সম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত রয়েছেন জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান।
২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন আমির মতিউর রহমান নিজামী কক্সবাজার সফর করেছিলেন। সেই সময় জামায়াত-সমর্থিত চারদলীয় জোট ক্ষমতায় থাকলেও নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় মহাজোট বিপুল বিজয় অর্জন করে। এরপর থেকে জামায়াত রাজনৈতিকভাবে দুর্বল হতে থাকে, বিশেষ করে দলটির শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ এবং তাদের ফাঁসি কার্যকরের ফলে সংগঠনটি কার্যত নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে।
২০১০ সালে যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদসহ দলের শীর্ষ নেতাদের গ্রেপ্তারের পর থেকে জামায়াতের রাজনৈতিক কার্যক্রম কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। ২০১৩ সালে হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা এবং শাহবাগ আন্দোলনের বিরোধিতার কারণে দলটির বিরুদ্ধে কঠোর সরকারী পদক্ষেপ নেওয়া হয়।
দীর্ঘ ১৬ বছর পর কক্সবাজারে জামায়াতের প্রকাশ্য কর্মী সম্মেলনকে দলটির রাজনৈতিক পুনর্জাগরণের প্রচেষ্টা হিসেবে দেখা হচ্ছে। জেলা জামায়াতের আমির অধ্যক্ষ মাওলানা নূর আহমদ আনোয়ারী জানান, জেলার প্রতিটি উপজেলা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড থেকে নেতাকর্মীরা এই সম্মেলনে অংশ নিচ্ছেন এবং আয়োজকদের দাবি অনুযায়ী এতে লক্ষাধিক নেতাকর্মীর সমাগম হতে পারে।
সম্মেলনকে কেন্দ্র করে কক্সবাজার শহরজুড়ে ব্যাপক আয়োজন করা হয়েছে। শহরের বিভিন্ন স্থানে জামায়াতের কর্মীরা ব্যানার, ফেস্টুন ও তোরণ নির্মাণ করেছে। সম্মেলন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য মেডিকেল টিম, অ্যাম্বুলেন্স, টেকনিক্যাল টিমসহ বিভিন্ন প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।
উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, এবারের সম্মেলনে নারীদের জন্য আলাদা বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। পুরুষদের মূল সম্মেলন কক্সবাজার সরকারি কলেজের মাঠে অনুষ্ঠিত হলেও নারীরা ইলিয়াস মিয়া চৌধুরী উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে বসবেন।
জামায়াতের কর্মীদের মধ্যে দীর্ঘদিন পর এ ধরনের আয়োজনের জন্য উচ্ছ্বাস দেখা গেছে। অনেক কর্মীই মনে করছেন, এই সম্মেলনের মাধ্যমে দলটি নতুনভাবে রাজনৈতিক মঞ্চে ফিরতে চাইছে। স্থানীয় এক কর্মী বলেন, “আমরা অনেক বছর পর এমন বড় একটি আয়োজনের সাক্ষী হতে পারছি। এটি আমাদের জন্য নতুন আশার বার্তা বহন করছে।”
একজন সিনিয়র নেতার মতে, “দলকে দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা করা হলেও সাংগঠনিকভাবে আমরা সবসময় সক্রিয় ছিলাম। এখন আমরা পুনরায় সংগঠনকে সুসংহত করতে চাই।”
জামায়াতের এই কর্মী সম্মেলনকে ঘিরে প্রশাসনও সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অতিরিক্ত সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে যাতে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না হয়। স্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তা জানান, “আমরা নিশ্চিত করছি যে সম্মেলন শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হয়। যদি কেউ আইনশৃঙ্খলা বিঘ্নিত করার চেষ্টা করে, তাহলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
সরকারের পক্ষ থেকে এখনও আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি, তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, জামায়াতের এই পুনরায় কার্যক্রম শুরু করা বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, জামায়াতের এই কর্মী সম্মেলন তাদের সংগঠনিক শক্তি প্রদর্শনের একটি কৌশল। আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে দলটি আবারও ময়দানে সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছে।
একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলেন, “যুদ্ধাপরাধের বিচার ও নেতাদের মৃত্যুদণ্ডের পর জামায়াত দীর্ঘদিন রাজনৈতিকভাবে দুর্বল ছিল। তবে এখন তারা আবারও সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে, যা আগামী দিনের রাজনীতিতে প্রভাব ফেলতে পারে।”
জামায়াত কি আবারও বড় রাজনৈতিক শক্তি হয়ে উঠবে? এ নিয়ে নানা বিশ্লেষণ রয়েছে। অনেকেই মনে করেন, দলটি মূলধারার রাজনীতিতে টিকে থাকতে চাইলে তাদের কৌশলগত পরিবর্তন আনতে হবে। অন্যদিকে, অনেকে মনে করেন, জামায়াতের পুনরুত্থান সরকারের কড়া নজরদারির মুখে পড়তে পারে।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জামায়াত কী ধরনের কৌশল নেয়, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
কক্সবাজারে জামায়াতে ইসলামীর কর্মী সম্মেলন দলটির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। এটি শুধু একটি সাধারণ রাজনৈতিক সমাবেশ নয়, বরং দলটির ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক পরিকল্পনার ইঙ্গিত বহন করছে। তবে এটি কতটা সফল হবে, তা নির্ভর করবে সরকারের প্রতিক্রিয়া, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও সাধারণ জনগণের গ্রহণযোগ্যতার ওপর।
আপনার মতামত লিখুন :