নিউইয়র্কভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (HRW) সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে বলেছে, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারকে এমন একটি নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে কাজ করতে হচ্ছে, যাদের দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতিকরণ করা হয়েছে এবং দায়মুক্তির সুবিধা দেওয়া হয়েছে। সংস্থাটি বলেছে, এই পরিস্থিতি পরিবর্তন করা না গেলে ভবিষ্যতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো অব্যাহত থাকবে।
প্রতিবেদনটি মঙ্গলবার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক স্বার্থ বাস্তবায়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে, যা নাগরিকদের মানবাধিকার হুমকির মুখে ফেলেছে।
গণতন্ত্রের সংগ্রাম ও নিরাপত্তা বাহিনীর ভূমিকা
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক এলেইন পিয়ারসন বলেন, "গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করতে গিয়ে প্রায় এক হাজার বাংলাদেশি তাদের জীবন উৎসর্গ করেছেন। এটি বাংলাদেশের জন্য একটি অধিকারভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলার এক ঐতিহাসিক সুযোগ তৈরি করেছে। তবে এই অর্জন হারিয়ে যেতে পারে যদি অন্তর্বর্তী সরকার দ্রুত কাঠামোগত সংস্কার না করে।"
তিনি বলেন, "আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অপব্যবহার রোধে শক্তিশালী পদক্ষেপ না নিলে ভবিষ্যতের সরকারও দমনমূলক নীতি চালিয়ে যেতে পারবে।"
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জুলাই-আগস্ট মাসে সরকারবিরোধী আন্দোলন চলাকালে বাংলাদেশ পুলিশ ও অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনী অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ করেছে।
একজন পুলিশ কর্মকর্তা হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে বলেছেন, "আমি মনে করি, আন্দোলনের সময় রাজনৈতিক নেতারাই পুলিশের ভূমিকা নির্ধারণ করেছেন। সিনিয়র কর্মকর্তারা সরাসরি গুলি চালানোর নির্দেশ দিচ্ছিলেন, যেন তারা ভিডিও গেম খেলছেন।"
আরেক কর্মকর্তা জানান, ঢাকার মেট্রোপলিটন পুলিশের সদর দপ্তর থেকে সিসিটিভি ফুটেজ দেখে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেওয়া হতো। সিনিয়র কর্মকর্তারা বলতেন, "কঠোর হতে হবে, বিশৃঙ্খলাকারীদের ছাড় দেওয়া যাবে না।" যদিও তারা সরাসরি `গুলি চালাও` শব্দ ব্যবহার করেননি, তবে তাদের নির্দেশ পরিষ্কার ছিল—সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে।
গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও নিরাপত্তা বাহিনীর ভূমিকা
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও গুমের ঘটনায় সরাসরি জড়িত।
একজন সামরিক কর্মকর্তা হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে জানান, শেখ হাসিনা ও তার সরকারের শীর্ষ নেতারা গুম ও হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে জানতেন। কিছু ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরাসরি গুম বা হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
তিনি বলেন, "আবদুল্লাহিল আমান আজমীকে আটকের পর তার স্বাস্থ্যের অবনতির বিষয়টি শেখ হাসিনা জানতেন। আমি বারবার তাকে মুক্তির অনুমতি চাইলে হাসিনা প্রত্যাখ্যান করেন। এক পর্যায়ে তিনি আমাকে সরাসরি বলেন, ‘আজমীকে হত্যা করো।’ আমি তা করিনি, তবে এরপর থেকে আর তার মুক্তির বিষয়ে কথা বলিনি।"
আরেকজন কর্মকর্তা বলেন, "আমি আমার ১০-১১ বছরের চাকরির অভিজ্ঞতায় র্যাবকে গুম ও হত্যা করতে দেখেছি। এসব ঘটনা বাস্তব। র্যাব যা করেছে, তা পুলিশ সদর দপ্তর ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতি ছাড়া সম্ভব নয়।"
২০১৬ সালে গুম হওয়া মীর আহমদ বিন কাসেম (আরমান) এর সাক্ষাৎকারও প্রতিবেদনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তিনি বলেন, এক নিরাপত্তা কর্মকর্তা তাকে জানিয়েছিলেন যে, আরমান, আজমী ও হুম্মাম কাদের চৌধুরীর গুমের বিষয়ে শেখ হাসিনাই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন।
নিরাপত্তা বাহিনীর তদন্তে বাধা ও নতুন আটককেন্দ্র
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ আরও বলেছে, গুম তদন্তে গঠিত কমিশনের কাজ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
কমিশনের সদস্যরা জানিয়েছেন, তারা নতুন আটটি অবৈধ আটককেন্দ্র চিহ্নিত করেছেন। তবে নিরাপত্তা বাহিনী প্রমাণ নষ্টের চেষ্টা করছে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।
আইনি ব্যবস্থার অপব্যবহার
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আন্দোলন চলাকালে নিরাপত্তা বাহিনী ও সরকার আইনগত ব্যবস্থার অপব্যবহার করেছে।
জুলাই-আগস্টের সহিংসতার পর আটটি মামলা পর্যালোচনা করেছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।
এই মামলাগুলোতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, কয়েকজন মন্ত্রীসহ মোট ২৯৭ জনকে আসামি করা হয়েছে এবং ৬০০ জনকে অজ্ঞাতপরিচয় হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
মামলার পাঁচজন বাদী হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে জানিয়েছেন, তারা জানতেন না কাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। পুলিশ বা স্থানীয় রাজনীতিবিদরা তাদের শুধু কাগজে স্বাক্ষর করতে বলেছিল।
একজন মা বলেন, তার ছেলে ঢাকায় বিক্ষোভের সময় নিহত হয়। তিনি যখন মামলা করতে যান, পুলিশ তাকে একটি প্রস্তুতকৃত এফআইআরে স্বাক্ষর করতে বলে।
তিনি বলেন, "আমি জানি না এই ৫০ জন অভিযুক্ত কে বা কিভাবে তারা আমার ছেলের হত্যায় জড়িত।"
সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে দমননীতি
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানায়, সরকারবিরোধী প্রতিবেদন করার জন্য ১৪০ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে।
চট্টগ্রামে ২৮ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলনের প্রকৃত ঘটনা বিকৃত করার অভিযোগ আনা হয়েছে।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের দুই স্বাস্থ্যকর্মী আমজাদ হোসেন ও নিজাম উদ্দিনের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ আনা হয়, যদিও তারা শুধুমাত্র আহতদের চিকিৎসা দিচ্ছিলেন।
আমজাদ হোসেন বলেন, "আমি হাসপাতালের দায়িত্বে ছিলাম এবং আহতদের চিকিৎসা দিচ্ছিলাম। কিন্তু আমাকে ওয়াসিম হত্যার মামলায় আসামি করা হয়েছে।"
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের সুপারিশ
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্তি নিশ্চিত করতে কাঠামোগত সংস্কার করা জরুরি।
তারা সুপারিশ করেছে:
- স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কাঠামোগত সংস্কার করতে হবে।
- আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে।
- র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) বিলুপ্ত করতে হবে।
- বিচার বিভাগ ও প্রসিকিউশনকে নির্বাহী বিভাগের প্রভাবমুক্ত রাখতে হবে।
এই প্রতিবেদন প্রকাশের পর বাংলাদেশ সরকার এখনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানায়নি। তবে অতীতে সরকার হিউম্যান রাইটস ওয়াচের অভিযোগগুলোকে "রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত" বলে উড়িয়ে দিয়েছে।
বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ গণতান্ত্রিক বিকাশ ও মানবাধিকার সুরক্ষায় এ প্রতিবেদন আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
আপনার মতামত লিখুন :