দীর্ঘ ২৪ বছরের শাসনের অবসান ঘটলো সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের। বিদ্রোহী যোদ্ধাদের সিরিয়ার রাজধানী দামেস্ক দখলের মুখে আজ রোববার সকালে একটি ব্যক্তিগত উড়োজাহাজে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান তিনি। তার পালানোর মধ্য দিয়ে সিরিয়ায় আল-আসাদ পরিবারের ৫৩ বছরের শাসনের অবসান হলো। উল্লেখ্য, বাশারের বাবা হাফিজ আল-আসাদ টানা ২৯ বছর দেশটি শাসন করেছিলেন। বাবার হাত ধরেই ক্ষমতায় এসেছিলেন বাশার আল- আসাদ।
সিরিয়ার বিভিন্ন শহর বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে যাওয়ার পরপরই তাঁরা রাজধানী দামেস্কের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। গত রাতে বিদ্রোহীরা রাজধানীর উপকণ্ঠে পৌঁছে যান এবং আজ সকালে দামেস্কে প্রবেশ করেন। বিদ্রোহের তোপের মুখে বাশার আল-আসাদ পালানোর পর বিদ্রোহীরা সিরিয়াকে ‘মুক্ত’ বলে ঘোষণা করেন।
বিবিসি তথ্যমতে, আজ সকালে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ দামেস্ক ত্যাগ করেছেন। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের বরাতে বলা হয়, দামেস্ক আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে একটি ব্যক্তিগত উড়োজাহাজ উড্ডয়ন করতে দেখা গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, সেটিতে বাশার আল-আসাদ ছিলেন। তবে এ বিষয়ে তারা নিশ্চিত নন। বিদ্রোহীরা ইতিমধ্যেই আলেপ্পো, হোমসসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। হোমস শহরের স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে বিদ্রোহী কমান্ডার হাসান আবদুল ঘানি জানান, এটি এখন তাদের দখলে।
আজ সকাল থেকেই দামেস্কে গোলাগুলির শব্দ শোনা যায়। শহরের বিদ্যুৎ-সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয় এবং ইন্টারনেট ছিলো খুবই ধীর গতির । এতে স্থানীয় বাসিন্দারা ঘরের বাইরে বের হতে ভয় পাচ্ছিলেন। দামেস্কের বারজেহ এলাকায় বিদ্রোহীরা প্রবেশ করলে সেখানে তীব্র লড়াই হয়। এরপর শহরের সেদনায়া কারাগারের দরজা খুলে বিদ্রোহীরা তিন হাজারের বেশি বন্দীকে মুক্তি দেয়। বিদ্রোহীরা ঘোষণা দেয়, এটি কারাগারে অত্যাচারের এক অধ্যায়ের সমাপ্তি।
বাশার আল-আসাদের স্ত্রী আসমা আসাদ এবং তাদের তিন সন্তান আগে থেকেই সিরিয়া ত্যাগ করেছিলেন। আসমা আসাদ গত নভেম্বর মাসে সন্তানদের নিয়ে রাশিয়ায় চলে যান। রয়টার্স জানায়, আসমা আসাদের ক্যানসার শনাক্ত হওয়ার পর থেকেই তিনি জনসমক্ষে আসছিলেন না।
সিরিয়ার প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ ঘাজি আল-জালালি বর্তমানে দামেস্কেই আছেন। তিনি বিদ্রোহীদের সঙ্গে প্রশাসনিক দায়িত্ব ভাগাভাগি করতে প্রস্তুত বলে জানান। বিদ্রোহী গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস) তাদের পক্ষ থেকে একটি বিবৃতিতে সিরিয়াকে মুক্ত ঘোষণার পাশাপাশি বিদ্রোহী বাহিনীকে সরকারি প্রতিষ্ঠানে প্রবেশ না করার নির্দেশ দিয়েছে।
বিদ্রোহী যোদ্ধারা বাশার আল-আসাদের পরিবারের প্রতীক হিসেবে পরিচিত তাঁর বাবা হাফিজ আল-আসাদের ভাস্কর্য ভেঙে ফেলেছেন। এটি সিরিয়ার জনগণের রাগ এবং দীর্ঘ প্রতীক্ষিত প্রতিশোধের প্রতিফলন হিসেবেই দেখা হচ্ছে।
হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস) এবং জোলানির নেতৃত্ব
সিরিয়ার স্বৈরাচারী শাসনের পতনে প্রধান ভূমিকা পালন করেছে ইসলামপন্থী বিদ্রোহী গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-শাম। এ গোষ্ঠীর প্রধান আবু মোহাম্মদ আল-জোলানি এক বিবৃতিতে বলেন, জালিম শাসকের যুগ শেষ হয়েছে এবং একটি নতুন যুগের সূচনা হয়েছে। জোলানির নেতৃত্বেই সিরিয়ায় বিদ্রোহী আন্দোলন সংগঠিত হয়েছে।
আবু মোহাম্মদ আল-জোলানির প্রকৃত নাম আহমেদ হুসাইন আল-শারা। সৌদি আরবে জন্ম নেওয়া এই নেতা ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী প্রতিরোধ আন্দোলনে অংশ নিয়ে পরিচিতি পান। সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরু হলে তিনি আল-কায়েদার সঙ্গে সম্পর্কিত আল-নুসরা ফ্রন্ট প্রতিষ্ঠা করেন। এরপরে তিনি আল-কায়েদার সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করে নতুন সংগঠন গঠন করেন এবং সিরিয়ায় গোষ্ঠীর কার্যক্রম সীমাবদ্ধ করেন।
২০১৬ সালে জোলানি আলেপ্পোর পতনের পর বিদ্রোহী যোদ্ধাদের সঙ্গে নিয়ে ইদলিবে শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করেন। পরবর্তীতে ২০১৭ সালে তিনি ছোট ছোট বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোকে একত্রিত করে হায়াত তাহরির আল-শাম গঠন করেন। এই গোষ্ঠীর লক্ষ্য ছিল বাশার আল-আসাদের শাসনের অবসান এবং ইরানের সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে সিরিয়া থেকে বিতাড়িত করা।
বাশার আল-আসাদের শাসনের পতন সিরিয়ার জন্য একটি বড় পরিবর্তন। বিদ্রোহীরা বর্তমানে সিরিয়ার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার কাজ করছে। তবে ভবিষ্যতে এই অঞ্চলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং পুনর্গঠন কতটা কার্যকর হবে তা নিয়ে বিশ্লেষকরা সতর্ক।
আপনার মতামত লিখুন :