`ভ্যালেন্টাইনস ডে ` শুধুমাত্র প্রেমের দিন নয় বরং এটি এক বহুমাত্রিক ইতিহাস ও সংস্কারের মিশ্রণ। প্রাচীন রোমের পৌত্তলিক রীতির ভিত্তিতে গড়ে উঠলেও খ্রিস্টীয় পবিত্রতা এবং পরবর্তীতে বাণিজ্যের সংস্পর্শে এ দিবসটি নতুন রূপ নিয়েছে। প্রাচীনকালের লুপারকালিয়া উৎসব থেকে শুরু করে সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের আত্মত্যাগ, মধ্যযুগের প্রেমের কবিতা এবং আধুনিক যুগের বাণিজ্যিকীকরণ সবকিছু মিলিয়েই আজকের ভ্যালেন্টাইনস ডে।
প্রাচীন রোমের লুপারকালিয়া: রক্ত, উর্বরতা ও উদ্দাম উৎসব
ভ্যালেন্টাইনস ডে-এর শিকড় প্রাচীন রোমের লুপারকালিয়া উৎসবে প্রোথিত, যা প্রতি বছর ১৩ থেকে ১৫ ফেব্রুয়ারি পালিত হতো। দেবতা লুপারকাস বা ফাউনাস, যিনি প্রকৃতির রক্ষক, তাঁর সম্মানে এ উৎসব উদযাপিত হতো। এই উৎসবে ছাগল ও কুকুর বলিদান দেওয়া হতো এবং বলিদানের রক্ত তরুণদের কপালে মাখিয়ে শুদ্ধ করা হতো। এরপর সেই বলিদান দেওয়া ছাগলের চামড়া নিয়ে তরুণেরা নগরের পথে ছুটে বেড়াতো এবং সেই চামড়া দিয়ে নারীদের স্পর্শ করতো, যা উর্বরতার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হতো। লাল রঙ এই উৎসবে বিশেষ গুরুত্ব পেত, যা রক্ত, উর্বরতা এবং বন্য উন্মাদনার প্রতীক। পুরো নগরী মেতে উঠতো বাঁধভাঙা উল্লাসে এবং প্রাকৃতিক প্রজনন শক্তির উদযাপনে।
তবে খ্রিস্টধর্মের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে লুপারকালিয়ার পৌত্তলিক রীতিকে অশোভন ও অনৈতিক বলে মনে করা হতে থাকে। ৪৯৬ খ্রিস্টাব্দে পোপ গেলাসিয়াস I এই উৎসব নিষিদ্ধ করেন এবং ১৪ ফেব্রুয়ারিকে সেন্ট ভ্যালেন্টাইন দিবস হিসেবে ঘোষণা দেন, যাতে প্রেম ও পবিত্রতার সঙ্গে দিনটি উদযাপিত হয়। এভাবে লুপারকালিয়ার উন্মাদনা ও অশ্লীলতার পরিবর্তে ভালোবাসা ও পবিত্রতার মিশেলে সেন্ট ভ্যালেন্টাইন দিবসের সূচনা হয়।
সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের শহীদত্ব: প্রেমের জন্য আত্মত্যাগ
৩য় শতকে রোম শাসিত হচ্ছিল সম্রাট ক্লডিয়াস II-এর অধীনে, যিনি বিশ্বাস করতেন যে যুবকেরা যদি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়, তবে তারা যুদ্ধের জন্য দুর্বল হয়ে পড়বে। তাই তিনি বিবাহ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। কিন্তু ভ্যালেন্টাইন নামের এক খ্রিস্টান পুরোহিত এই আদেশ অমান্য করেন। তিনি গোপনে প্রেমিকযুগলদের বিবাহ দিতেন এবং প্রেমের পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ করতেন। এ কারণে তাকে বন্দি করা হয় এবং ২৬৯ খ্রিস্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারি মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।
কিংবদন্তি অনুসারে, মৃত্যুর আগে ভ্যালেন্টাইন তাঁর প্রিয়াকে একটি চিঠি লেখেন, যার শেষে লেখা ছিল— "তোমার ভ্যালেন্টাইন"। এই ঘটনার মাধ্যমে জন্ম নেয় এক অমর প্রেমের কাহিনী, যা ভ্যালেন্টাইনস ডে-কে প্রেমের প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। পবিত্রতা ও আত্মত্যাগের এই ইতিহাসই দিনটিকে খ্রিস্টীয় ধর্মীয় গুরুত্ব দেয় এবং প্রেমের প্রতীক হিসেবে বিশ্বজুড়ে পরিচিত করে তোলে।
মধ্যযুগের প্রেমের কবিতা: ভ্যালেন্টাইনের রূপান্তর
১৪শ শতকে কবি জিওফ্রে চসার তাঁর কবিতায় উল্লেখ করেন— "১৪ ফেব্রুয়ারি, এই দিনে পাখিরা জোড়া বাঁধে, হৃদয়ে প্রেম জাগে।" এই কবিতার মাধ্যমে সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের নাম প্রেমের প্রতীক হিসেবে আরও বেশি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। মধ্যযুগে ইউরোপে শুভেচ্ছা বিনিময়ের রীতি শুরু হয় এবং লেখা হয় প্রথম ভ্যালেন্টাইন কার্ড। ধীরে ধীরে ভালোবাসা প্রকাশের প্রতীক হিসেবে এ দিনটির গ্রহণযোগ্যতা বাড়তে থাকে।
আধুনিক যুগে বাণিজ্যিকীকরণ: প্রেমের অর্থনৈতিক রূপান্তর
১৮শ ও ১৯শ শতকে হাতে লেখা ভালোবাসার চিঠির জায়গায় ছাপানো কার্ডের প্রচলন শুরু হয়। হলমার্ক কোম্পানি প্রথম বাণিজ্যিকভাবে ভ্যালেন্টাইন কার্ড বাজারজাত করে, যা দিনটির বাণিজ্যিকীকরণের সূচনা করে। ২০শ শতকে ভালোবাসার প্রতীক হয়ে ওঠে চকোলেট, গোলাপ, হীরার আংটি এবং দামি উপহার। "ভালোবাসা প্রকাশ করতে চাইলে উপহার দাও"— এই ধারণা বাণিজ্যিকীকরণের মূলমন্ত্র হয়ে ওঠে। বর্তমানে ভ্যালেন্টাইনস ডে মানে বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি গোলাপ বিক্রি, চকোলেটের পাহাড়, দামি উপহার আর বিলাসবহুল ডিনার। প্রেমের দিনে বাণিজ্যের সুনামি বইতে থাকে।
খ্রিস্টধর্ম, রাজনীতি ও সংস্কারের পরিবর্তন
ভ্যালেন্টাইনস ডে শুধুমাত্র প্রেমের দিন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি, এর পেছনে ছিল খ্রিস্টধর্মের রাজনৈতিক চতুরতা ও সাম্রাজ্যবাদী উদ্দেশ্য। রোমান সাম্রাজ্য ছিল বহু সংস্কৃতির মিশ্রণ। পৌত্তলিক উৎসবগুলো নিষিদ্ধ করলে বিদ্রোহ বাঁধতে পারত, তাই পুরোনো উৎসবগুলোর রূপ বদলে খ্রিস্টীয় রঙে রাঙানো হয়। সাতুরনালিয়া থেকে ক্রিসমাস, সামহেইন থেকে হ্যালোইন, এবং লুপারকালিয়া থেকে ভ্যালেন্টাইনস ডে— সবই ছিল খ্রিস্টধর্মের কৌশলগত সিদ্ধান্ত।
প্রেমের ইতিহাস ও পরিবর্তনের কাব্য
ভ্যালেন্টাইনস ডে কি শুধুই প্রেমের দিন, নাকি এর মাঝে মিশে আছে ইতিহাস, ধর্ম, রাজনীতি ও বাণিজ্যের সূক্ষ্ম খেলা? প্রেম কি শুধুই হৃদয়ের, নাকি এটি এক বহুমাত্রিক রঙিন ছায়া, যেখানে একদিকে ভ্যালেন্টাইনের আত্মত্যাগ, অন্যদিকে বাণিজ্যের হাতছানি? যুগে যুগে ভালোবাসা নতুন রূপ নেয়, নতুন ভাষায় কবিতা লেখে। ঠিক তেমনি ভ্যালেন্টাইনস ডে-ও বদলে গেছে, কিন্তু তার মূল প্রতীকী অর্থ ‘প্রেম ও ভালোবাসা’ আজও অমলিন।
আপনার মতামত লিখুন :