ইংরেজি বছরের সর্বশেষ দিন ৩১ ডিসেম্বর। পুরোনো বছরকে বিদায় ও নতুন বছরের আগমনকে বরণ করে নিতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে উৎসব ও আনন্দের এক বিশেষ উপলক্ষ হয় এই দিনটি। বাংলাদেশেও এই দিন টি আতশবাজি, পটকা, ফানুস উড়ানোর মধ্য দিয়ে উৎযাপন করা হয়। কিন্তু এই আনন্দের আয়োজনের মাঝেও থাকে এক অজানা বিপদ। বিশেষ করে ফানুসের আগুন, যা কখনো কখনো পরিণত হয় ভয়াবহ দুর্ঘটনায়।
চীনা সংস্কৃতি থেকে আগত ফানুস এক বিশেষ আলোর ব্যবস্থা যা সাধারণত উল্লাসের সময় আকাশে ছেড়ে দেয়া হয়। বৌদ্ধ ধর্মেও এটি ধর্মীয় রীতিতে ব্যবহৃত হয়। তবে বর্তমানে এটি আনন্দ আয়োজনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে থার্টি ফার্স্ট নাইটে বাংলাদেশের আকাশে ফানুসের এক বিশাল প্রতিযোগিতা দেখা যায়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, ফানুসের আগুনে দেশে একাধিকবার দুর্ঘটনা ঘটেছে এবং মানুষের জীবন ও সম্পদের ক্ষতির কারণ হয়েছে।
তানজিম উমায়ের
উমায়েরের মর্মান্তিক মৃত্যু
২০২১ সালে থার্টি ফার্স্ট নাইটে আতশবাজির ভয়াবহ শব্দে ভয় পেয়ে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় শিশু তানজিম উমায়ের। মাত্র চার মাস ১৯ দিনের শিশুটি জন্মগতভাবেই হৃদরোগে আক্রান্ত ছিল। থার্টি ফার্স্টের আতশবাজির শব্দে অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে হাসপাতালে নেয়া হয় এবং সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২০২২ সালের প্রথম দিনটায় তার মৃত্যু হয়। থার্টি ফার্স্ট নাইট উৎযাপনের ক্ষেত্রে এই ঘটনা একটি তীব্র সতর্কবার্তা প্রদান করলেও আনন্দের মাঝে নিরাপত্তার বিষয়টি বার বার উপেক্ষিত হচ্ছে।
স্বাস্থ্য ও পরিবেশের উপর প্রভাব
থার্টি ফার্স্ট নাইটে আতশবাজি ও পটকা ফোটানো শুধু মানুষের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যই ক্ষতিকর নয়, এটি পরিবেশের জন্যও বিপজ্জনক। আতশবাজির উচ্চ শব্দজনিত সমস্যাগুলোর মধ্যে শ্রবণশক্তি হ্রাস, স্মরণশক্তি কমে যাওয়া, ঘুমের ব্যাঘাত, মানসিক অস্থিরতা, উচ্চ রক্তচাপ, স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বৃদ্ধি ইত্যাদি অন্যতম। এছাড়াও এগুলোর ফলে শব্দদূষণ ও বায়ুদূষণ বৃদ্ধি পায় যা জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
ফানুসের আগুনে অগ্নিকাণ্ড
অতীতে ফানুসের আগুনে একাধিকবার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। ২০২৩ সালে নতুন বছর শুরুর প্রথম দিকে ফানুসের আগুনে প্রায় ১৯ লাখ ৭৫ হাজার টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। এমকি তখন সদ্য চালু হওয়া মেট্রোরেলও ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে চলাচলে দুই ঘন্টা বিলম্ব করেছিল। ২০২২ সালে প্রায় একশো টি অগ্নিকাণ্ড ঘটে বিপুল পরিমাণ ক্ষতির সম্মুখীন হন ভুক্তভোগীরা। ২০২১ ও ২০২০ সালেও বিভিন্ন জায়গায় আতশবাজি ও ফানুসের আগুনে ক্ষয়ক্ষতি লক্ষ্য করা যায়। এই সকল ঘটনাগুলো প্রমাণ করে যে এসব আয়োজন কখনোই নিরাপদ নয়।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের আহ্বান
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় ৩১ ডিসেম্বর থার্টি ফার্স্ট নাইটে আতশবাজি ও ফানুস ফোটানো থেকে বিরত থাকার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। মন্ত্রণালয় জানায়, এই ধরনের কর্মকাণ্ড জনস্বাস্থ্য, জীববৈচিত্র্য এবং পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। এগুলো শব্দদূষণ ও বায়ুদূষণের পাশাপাশি মানুষের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে।
এছাড়াও শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা, ২০০৬-এর অধীনে থার্টি ফার্স্ট নাইটের দিন অবৈধভাবে আতশবাজি ও পটকা ফোটানো দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। প্রথম অপরাধের জন্য ১ মাস পর্যন্ত কারাদণ্ড বা ৫ হাজার টাকা জরিমানা হতে পারে এবং পরবর্তী অপরাধে ৬ মাস পর্যন্ত কারাদণ্ড বা ১০ হাজার টাকা জরিমানা হতে পারে।
দেশের সুরক্ষায় আমাদের দায়িত্ব
একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে আমাদের সকলের দায়িত্ব হলো অন্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। যেহেতু বাংলাদেশে বৈদ্যুতিক তার ও অবকাঠামো অনেক সময় উন্মুক্ত থাকে, তাই ফানুসের আগুন এই সকল উন্মুক্ত জায়গার জন্য কখনোই নিরাপদ নয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পরিস্থিতি ও পরিপ্রেক্ষিত ভিন্ন হতে পারে তবে আমাদের উচিত নিরাপদ ও দায়িত্বশীল হয়ে থার্টি ফার্স্ট নাইট উদযাপন করা। যদি আমরা একে অপরের নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে উৎসব পালন করি তাহলে এই দিনটি কেবল আনন্দের দিন হয়ে থাকবে নচেৎ নতুন বছর শুরু করতে হবে অন্যায়, অপরাধের কালিমা মাথায় নিয়ে।
আনন্দের পাশাপাশি নিরাপত্তার অঙ্গীকার
থার্টি ফার্স্ট নাইট আমাদের আনন্দ ও উল্লাসের দিন। তবে এই আনন্দের সঙ্গে দায়িত্বশীলতা ও নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের উচিত আতশবাজি, পটকা ও ফানুসের ব্যবহার থেকে বিরত থাকা, যাতে আমরা যেন এই দিনটিকে নিরাপদ, আনন্দময় ও শান্তিপূর্ণভাবে উদযাপন করতে পারি। আসুন, আমরা সবাই একে অপরের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে নতুন বছরটি বরণ করি।
আপনার মতামত লিখুন :