মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন আজ শুক্রবার দিবাগত রাত ১২টা ১ মিনিটে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ভাষা শহীদদের প্রতি পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। তবে এ শ্রদ্ধা নিবেদনের সময় ‘গো ব্যাক চুপ্পু’ শ্লোগানে উত্তাল হয় শহীদ মিনার চত্বর। বিপ্লবী ছাত্র পরিষদের আহ্বানে রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে এ বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়।
রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে পৌঁছান রাত ১২টা বাজার কয়েক মিনিট আগে। তাকে অভ্যর্থনা জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমেদ। নির্ধারিত সময় অনুযায়ী রাত ১২টা ১ মিনিটে রাষ্ট্রপতি শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন এবং ভাষা শহীদদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানান। এ সময় শহীদদের আত্মার শান্তি কামনায় এক মিনিট নীরবতা পালন করেন তিনি।
রাষ্ট্রপতির আগমনের সঙ্গে সঙ্গে শহীদ মিনার চত্বরে উপস্থিত শিক্ষার্থী ও জনতা বিক্ষোভ শুরু করেন। ‘গো ব্যাক চুপ্পু’ এবং বিভিন্ন স্লোগানে তারা তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করেন। বিক্ষোভকারীদের অভিযোগ, রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন স্বৈরাচারী সরকারকে সমর্থন দিয়ে গণহত্যার পথ সুগম করেছেন। তাদের মতে, তিনি ২০২৪ সালের জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনের পর ক্ষমতাসীন সরকারকে শপথবাক্য পাঠ করিয়ে স্বৈরাচারী শাসন প্রতিষ্ঠার সুযোগ করে দিয়েছেন।
বিপ্লবী ছাত্র পরিষদের আহ্বায়ক আবদুল ওয়াহেদ বলেন, “চুপ্পু (রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন) পদত্যাগ করে বিচারের মুখোমুখি হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। তিনি শেখ হাসিনার অবৈধ কর্মকাণ্ডকে অনুমোদন দিয়েছেন এবং জুলাই বিপ্লবের সময় হাজারো ছাত্রজনতার হত্যাকাণ্ডের অন্যতম কুশীলব ছিলেন।”

এর আগে বৃহস্পতিবার (২০ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বিপ্লবী ছাত্র পরিষদ কালো পতাকা মিছিল বের করে। তারা একুশের প্রথম প্রহরে রাষ্ট্রপতির শহীদ মিনারে আগমন প্রতিহত করার ঘোষণা দেন।
বিক্ষোভের মধ্যেই রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন এবং এরপর দ্রুত শহীদ মিনার এলাকা ত্যাগ করেন। এ সময় শহীদ মিনার এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়।
রাষ্ট্রপতির শ্রদ্ধা নিবেদনের পরপরই অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহম্মদ ইউনূস এবং প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এরপর উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যরা, বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত ও তিন বাহিনীর প্রধানগণ পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন।
ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে শহীদ মিনার চত্বর জুড়ে সর্বস্তরের মানুষের ঢল নেমেছিল। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গাইতে গাইতে খালি পায়ে ফুল হাতে নিয়ে মানুষজন শহীদ মিনারে আসেন। অনেকের চোখে ছিল অশ্রু, আর কণ্ঠে ভাষা শহীদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।

দিবসটি উপলক্ষে সারা দেশে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে নানা কর্মসূচির আয়োজন করা হয়। সকাল থেকেই বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও সামাজিক সংগঠন র্যালি বের করে এবং শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে। এছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, কবিতা আবৃত্তি ও আলোচনাসভার আয়োজন করা হয়।
১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এরপর থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। এ বছরের মূল প্রতিপাদ্য ছিল—‘মেক ল্যাঙ্গুয়েজেস কাউন্ট ফর সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট’।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান সরকার বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি না দেওয়ার প্রতিবাদে ছাত্র ও সাধারণ জনগণ ঢাকার রাজপথে নেমে আসে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে মিছিল বের করলে পুলিশের গুলিতে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ আরও অনেকেই প্রাণ হারান। ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই স্বাধীনতার চেতনা তীব্র হয়, যার চূড়ান্ত ফলাফল ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা অর্জন।
এই ঐতিহাসিক দিবসে জাতি আবারও ভাষা শহীদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে তাদের আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করেছে।
আপনার মতামত লিখুন :