মেহেরপুরের সড়কে একদিনে ঘটে গেল এযাবৎকালের সবচেয়ে ভয়াবহ ট্র্যাজেডি। পাঁচ ঘণ্টার ব্যবধানে একই সড়কে তিনটি পৃথক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন তিন তরুণ শিক্ষার্থী, যাদের প্রত্যেকেই ছিলেন প্রবাসী পিতার সন্তান। এ সময় গুরুতর আঘাতপ্রাপ্ত হন একজন শিক্ষক ও সাবেক উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান।
সম্ভাবনাময় তিনটি জীবন অকালে ঝরে যাওয়ার এই মর্মান্তিক ঘটনায় পুরো মেহেরপুরজুড়ে নেমে এসেছে শোকের ছায়া।
মেহেরপুর-কুষ্টিয়া আঞ্চলিক মহাসড়কে বুধবার (৮ জানুয়ারি) দুপুর ২ টা থেকে সন্ধ্যা ৬ টায় গাংনী উপজেলার আকুবপুর, অলিনগর ও পৌর শহরে এই দুর্ঘটনাগুলো ঘটে।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, গাংনী পৌর শহরে রাজা ক্লিনিক সংলগ্ন মহাসড়কে কনস্ট্রাকশন কাজে নিয়োজিত একটি ট্রাকের চাকায় পিষ্ট হয়ে মোস্তাফিজুর রহমান সংগ্রাম গুরুতর আহত হন। আহতাবস্থায় তাকে উদ্ধার করে কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তিনি বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামীর গাংনী উপজেলা শাখার সূরা সদস্য, উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান এবং বাওট আদর্শ বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক।
অন্যদিকে, দুপুরের ঘটনার দেড় ঘণ্টা পর বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে গাংনী উপজেলার আকুবপুর এলাকায় একটি লোকাল বাস ও মোটরসাইকেলের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে পীরতলা গ্রামের সৌদি প্রবাসী আলেক হোসেনের ছেলে সিয়াম হোসেন (১৮) এবং একই গ্রামের সৌদি প্রবাসী সোহরাব হোসেনের ছেলে আবদুল্লাহেল বাকী (১৮) নিহত হন। তারা দুজনেই কুষ্টিয়া ইসলামিয়া কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র ও সহপাঠী ছিলেন।
সর্বশেষ সন্ধ্যা ৬টার দিকে বামুন্দি উপশহরের অলিনগর এলাকায় একটি দ্রুতগামী ট্রাকের চাকায় পিষ্ট হয়ে ধানখোলা ইউনিয়নের চিৎলা গ্রামের প্রবাসী হাফিজ আলীর ছেলে শিপন (১৭) ঘটনাস্থলেই মারা যান। তিনি গাংনী পাইলট মাধ্যমিক অ্যান্ড কলেজের বিএম শাখার একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিলেন। এ ঘটনায় শিপনের খালাতো ভাই খোকন (২৩) গুরুতর আহত হলে তাকে স্থানীয় একটি ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়েছে।
স্থানীয় ফায়ার স্টেশন সূত্রে জানা যায়, একটি কাঁচামালবাহী ট্রাক ওভারটেক করার সময় নিয়ন্ত্রণ হারানোর ফলে ট্রাকের চাকায় পিষ্ট হয়ে শিপনের মৃত্যু ঘটে।
গাংনী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বানী ইসরাইল বলেন, "ঘটনার খবর পেয়ে পুলিশ দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে। প্রাথমিক তদন্ত চলছে, এবং প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, সড়কে অতিরিক্ত গতি ও ওভারটেকিংয়ের প্রবণতা এই দুর্ঘটনার প্রধান কারণ। তারা সড়ক সংস্কার ও স্পিডব্রেকার বসানোর দাবি জানিয়েছেন।
স্থানীয় শিক্ষক নুরুল আমিন বলেন, "যেসব দুর্ঘটনায় তরুণ শিক্ষার্থীরা প্রাণ হারায়, তা আমাদের সমাজের জন্য বড় দুঃখজনক। ট্রাফিক আইন সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে স্কুল-কলেজে এই বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।
ডা. আদিলা আজহার আরশি বলেন, "সড়ক দুর্ঘটনা রোধে ব্যক্তিগত সচেতনতার পাশাপাশি প্রশাসনের কঠোর নজরদারি এবং আইনের প্রয়োগ জরুরি। নিরাপদ সড়ক আমাদের সবার অধিকার।"
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মেহেরপুরে সড়ক দুর্ঘটনার হার উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। জেলা পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে মেহেরপুরে ১০৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৫ জন প্রাণ হারিয়েছেন এবং প্রায় ৭০ জন আহত হয়েছেন। ২০২৫ সালে ইতোমধ্যে দুর্ঘটনার সংখ্যা ১৫টি ছাড়িয়েছে।
সড়ক দুর্ঘটনা রোধে কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে এমন ট্র্যাজেডি চলতেই থাকবে। প্রশাসন ও জনগণের যৌথ উদ্যোগই পারে এই প্রাণহানি কমিয়ে আনতে।
আপনার মতামত লিখুন :