বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন মোড় নিতে যাচ্ছে, কারণ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে। এই দলটি কেবল কিছু নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করবে না, বরং সমাজের সকল স্তরের মানুষকে সম্পৃক্ত করার লক্ষ্য নিয়েছে। দলটির নাম, প্রতীক এবং ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণের জন্য সংগঠন দুটি দেশব্যাপী জনমত সংগ্রহ কর্মসূচি হাতে নিয়েছে।
বুধবার রাজধানীর বাংলামোটরে রূপায়ণ ট্রেড সেন্টার কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ এই ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, "বাংলাদেশে প্রচলিত রাজনৈতিক ব্যবস্থায় জনগণের প্রকৃত অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়নি। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদী সরকারের পতন ঘটানো সম্ভব হলেও রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় থাকা পুরনো শোষণ ও বৈষম্য এখনো বিদ্যমান। আমরা সেই কাঠামো ভেঙে নতুন এক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গঠনের লক্ষ্যে কাজ করছি।
নতুন দলের মূল লক্ষ্য হবে সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করা। সংবাদ সম্মেলনে হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, "আমরা এমন একটি রাজনৈতিক দল গঠন করতে চাই যা বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যর্থতাকে পেছনে ফেলে জনগণের প্রকৃত আকাঙ্ক্ষা পূরণ করবে।"
তিনি আরও জানান, এই দলটি বিশেষত তরুণদের নেতৃত্বে পরিচালিত হবে এবং তাদের নতুন রাষ্ট্রকাঠামো ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির ধারণাকে বাস্তবায়ন করবে।
জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, "আমরা এই দলকে নিছক একটি রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে দেখতে চাই না। এটি হবে জনগণের আন্দোলনের প্ল্যাটফর্ম, যেখানে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মতামত গুরুত্ব পাবে।"
নতুন রাজনৈতিক দলের নীতি ও কর্মসূচি নির্ধারণের ক্ষেত্রে জনগণের মতামতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হবে বলে সংগঠন দুটি জানিয়েছে। এ লক্ষ্যে দেশব্যাপী এক লাখ মানুষের মতামত সংগ্রহ করার কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে।
সংগঠনের নেতারা জানিয়েছেন, "আপনার চোখে নতুন বাংলাদেশ" স্লোগানে পরিচালিত এই কর্মসূচির মাধ্যমে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মতামত নেওয়া হবে। রিকশাচালক, দোকানদার, দিনমজুর, গৃহকর্মী, শিক্ষক, ঝাড়ুদারসহ সমাজের সকল স্তরের মানুষের সাথে সংযোগ স্থাপন করা হবে। তাদের মতামতের ভিত্তিতেই নতুন দলের নাম ও প্রতীক নির্ধারণ করা হবে।
নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, "আমরা শুধু শহরভিত্তিক রাজনীতি করব না, গ্রাম-গঞ্জ, শ্রমিক-মজুর, বস্তিবাসীসহ সকলকে সম্পৃক্ত করে নতুন রাজনৈতিক দল গড়ে তুলব। জনগণের মতামত নেওয়ার জন্য আমাদের কমিটিগুলো মাঠপর্যায়ে কাজ শুরু করেছে।"
সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা অভিযোগ করেন, বাংলাদেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলো বারবার জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে উপেক্ষা করেছে। তারা ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতি করেছে, সাধারণ মানুষের জীবনের উন্নতির জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। ফলে, সাধারণ মানুষ রাজনৈতিক কাঠামোর বাইরে থেকে গেছে এবং শোষিত ও বৈষম্যের শিকার হয়েছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখ্য সংগঠক আব্দুল হান্নান মাসউদ বলেন, "১৯৪৭ সালের পাকিস্তান আন্দোলন, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ, ১৯৯০ সালের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন—সবকিছুই ছিল জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। কিন্তু আমরা এখনো প্রকৃত অর্থে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। আমাদের লক্ষ্য হবে সেই অসমাপ্ত কাজগুলো সম্পন্ন করা।"
নতুন রাজনৈতিক দলটি জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে চায়। হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, "এই দল কেবল কিছু মানুষের নয়, বরং সকলের কণ্ঠস্বর হবে। আমরা সব নাগরিকের কথা শুনে নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তুলতে চাই।"
তিনি আরও বলেন, "আমরা এমন একটি রাজনীতি চাই যেখানে শুধু নির্বাচনের সময় জনগণের দরজায় কড়া নাড়া হবে না, বরং প্রতিটি সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে জনগণের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া হবে।"
নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা এখনও দেওয়া হয়নি। তবে সংগঠন দুটি জানিয়েছে, জনমত সংগ্রহের পর দলটির নাম, প্রতীক এবং গঠন কাঠামো চূড়ান্ত করা হবে। পরবর্তীতে একটি নীতি-আদর্শ নির্ধারণী সম্মেলনের মাধ্যমে দলটির আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসবে।
জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, "বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এটি একটি অনন্য উদ্যোগ, যেখানে এত বিশাল পরিসরে জনমত সংগ্রহ করা হচ্ছে।"
নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের ঘোষণাকে দেশের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ ইতিবাচকভাবে দেখছেন। একজন কলেজ শিক্ষক বলেন, "আমরা দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যর্থতা দেখছি। যদি সত্যিই একটি গণমুখী দল গঠিত হয়, তাহলে এটি দেশের জন্য মঙ্গলজনক হবে।"
রিকশাচালক মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, "রাজনীতি বড়লোকদের জন্য, গরিবদের কথা কেউ শোনে না। যদি এই দল সত্যি আমাদের কথা শোনে, তাহলে ভালো হবে।"
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. মো. আসিফ হোসেন বলেন, "যেকোনো নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করা চ্যালেঞ্জিং। কিন্তু যদি এটি সত্যিকার অর্থে গণতান্ত্রিক হয় এবং জনগণের মতামতকে গুরুত্ব দেয়, তাহলে এটি প্রচলিত রাজনীতিতে নতুন ধারা আনতে পারে।"
তিনি আরও বলেন, "তবে শুধু দল গঠন করলেই হবে না, এটি কীভাবে সংগঠিত হয়, কীভাবে জনগণের আস্থা অর্জন করে এবং কীভাবে বিদ্যমান রাজনৈতিক কাঠামোর সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে, সেটাই মূল বিষয়।"
বাংলাদেশের রাজনীতিতে পরিবর্তনের জন্য নতুন দলের এই উদ্যোগ গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। তবে এটি কতটা সফল হবে, তা নির্ভর করবে দলটির সংগঠন, নীতি, কার্যক্রম এবং জনগণের সাথে তাদের সংযোগের ওপর। দেশব্যাপী জনমত সংগ্রহের যে বিশাল উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তা ইতোমধ্যে রাজনৈতিক মহলে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।
নতুন রাজনৈতিক দলটি সত্যিই জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারবে কি না, তা সময়ই বলে দেবে। তবে এটুকু নিশ্চিত, এই উদ্যোগ বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এক নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে যাচ্ছে।
আপনার মতামত লিখুন :