প্রাক্-ইতিহাস এবং মুঘল আমল: মঠবাড়ীয়া উপজেলার ইতিহাস মুঘল আমল থেকে শুরু হলেও, এর প্রাচীন ইতিহাস খুবই সমৃদ্ধ। সুলতানী আমল এবং মুঘল শাসনের সময় থেকে এই অঞ্চলে গুরুত্ব বাড়তে থাকে। সুবেদার মুর্শিদ কুলি খাঁর আমলে আগা বাকের খাঁ কে পাঠানো হয় কির্তন খোলা নদীর তীরঘেঁষে চন্দ্রদ্বীপ এলাকার শাসন পরিচালনার জন্য। এটি ছিল এক নতুন ভৌগোলিক অঞ্চলের সূচনা, যা পরবর্তীতে বাকের গঞ্জ নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। এই অঞ্চলের ইতিহাস ও নামকরণও সংশ্লিষ্ট অঞ্চলগুলির মধ্যে সৃষ্ট রাজনৈতিক ও সামাজিক সম্পর্কের ফলস্বরূপ।
মঠবাড়িয়ার নামকরণও এর প্রাচীন ইতিহাসের এক বিশেষ অধ্যায়। "মঠ" ও "বাড়িয়া"—দ্বয়ে মিলে অঞ্চলটির নামকরণ হয় মঠবাড়িয়া। এখানে অনেক হিন্দু ধর্মাবলম্বী মঠ ও আশ্রমের স্থাপন থাকায় এটি একসময় হিন্দুদের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে।
মঠবাড়িয়া থানার প্রতিষ্ঠা: মঠবাড়িয়া থানার প্রতিষ্ঠা ১৯০৪ সালে। এরপর থেকেই মঠবাড়িয়া উপজেলার আধুনিক ইতিহাস শুরু হয়। উপজেলা হিসেবে স্বীকৃতি পায় এবং দ্রুত উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যায়।
প্রধান ইউনিয়ন ও পৌরসভা: মঠবাড়িয়া উপজেলায় বর্তমানে একটি পৌরসভা এবং ১১টি ইউনিয়ন রয়েছে। এগুলো হলো মঠবাড়িয়া পৌরসভা, আমড়াগাছিয়া, টিকিকাটা, তুষখালী, দাউদখালী, ধানীসাফা, বড় মাছুয়া, বেতমোর রাজপাড়া, মঠবাড়িয়া, মিরুখালী, শাপলেজা, এবং হলতা গুলিশাখালী ইউনিয়ন।
বিশিষ্ট কৃতি সন্তানরা: মঠবাড়িয়া বহু কৃতি সন্তান উপহার দিয়েছে, যারা দেশের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। এর মধ্যে শহীদ নূর হোসেন (১৯৮৭), মহিউদ্দিন আহমেদ (১৯৯৭), খান সাহেব হাতেম আলী জমাদার (১৮৭২-১৯৮২), এবং মেজর (অবঃ) মেহেদী আলী ইমাম (১৯৯৬) উল্লেখযোগ্য। এছাড়া, করপোরাল আব্দুস সামাদ, গনপতি হালদারসহ আরো অনেক মহান ব্যক্তি তাদের কর্মজীবনে মঠবাড়িয়ার গৌরব বর্ধিত করেছেন।
ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান: মঠবাড়িয়া উপজেলায় ধর্মীয় স্থাপনাগুলোর মধ্যে মসজিদ, মন্দির এবং তীর্থস্থান গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে। বন্দর জামে মসজিদ, সাফা জামে মসজিদ এবং মঠবাড়িয়ার হরিমন্দির বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
এছাড়া, এখানকার সাংস্কৃতিক জীবনে রয়েছে লাইব্রেরি, নাট্যদল, ক্লাব, সিনেমা হলসহ নানা সামাজিক সাংস্কৃতিক আয়োজন। পত্রিকা ও সাময়িকীর মধ্যে "মঠবাড়ীয়া সমাচার" উল্লেখযোগ্য, যা স্থানীয় সংবাদ পরিবেশন করে থাকে।
স্বাধীনতা সংগ্রামে মঠবাড়িয়া: ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে মঠবাড়িয়ার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তুষখালী অঞ্চলে কৃষক বিদ্রোহের ইতিহাস রয়েছে, যা ১৮৩০ থেকে ১৮৭০ সাল পর্যন্ত ইজারাদারদের বিরুদ্ধে ছিল। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে ঝাটিপুনিয়া নামক স্থানে রাজাকারবাহিনী ১২ জন মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করে, যার বেদনাদায়ক স্মৃতি আজও বাঁচিয়ে রেখেছে এই অঞ্চল।
প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য: মঠবাড়িয়া উপজেলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও বহু লোকমুখে শোনা যায়। এখানে রয়েছে বলেশ্বরী, কচা ও পোনা নদী, যা এই অঞ্চলের কৃষি ও পরিবেশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
শিক্ষা ও কলা-সংস্কৃতি: মঠবাড়িয়া উপজেলায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেশ উল্লেখযোগ্য। এখানে মোট ৫টি কলেজ, ৪৭টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ১৯৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ আরও কিছু স্যাটেলাইট স্কুল এবং মাদ্রাসা রয়েছে। মঠবাড়িয়া সরকারি ডিগ্রি কলেজ, মহিউদ্দীন মহিলা কলেজ এবং কে.এম. লতিফ ইনস্টিটিউশন (১৯২৮) এর মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এখানে শিক্ষার মান উন্নয়নে কাজ করে চলেছে।
অর্থনীতি ও কৃষি: মঠবাড়িয়ার অর্থনীতির মূল ভিত্তি কৃষি। ধান, গম, আখ, শাকসবজি, ডাল সহ অন্যান্য কৃষিপণ্য এখানে ব্যাপকভাবে উৎপাদিত হয়। আম, নারিকেল, কাঁঠাল, কলা এবং সুপারি এই অঞ্চলের প্রধান ফল। তবে, কৃষি কাজের পাশাপাশি এই অঞ্চলে বিভিন্ন ছোট খাটো শিল্প ও কলকারখানাও গড়ে উঠেছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল বরফকল, রাইস মিল এবং তাঁতশিল্প।
যোগাযোগ ব্যবস্থা: মঠবাড়িয়া উপজেলায় যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত। এখানে পাকা রাস্তা, আধা-পাকা রাস্তা এবং কাঁচা রাস্তার মিশ্রণ রয়েছে। এছাড়া, নদীপথে যোগাযোগের মাধ্যমও রয়েছে।
স্বাস্থ্যসেবা: মঠবাড়িয়া উপজেলায় স্বাস্থ্যসেবার দিকেও কিছু উন্নয়ন হয়েছে। এখানে ১টি হাসপাতাল, ৪৯টি পল্লী স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র, ২টি উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র এবং ৭টি পরিবার পরিকল্পনা কেন্দ্র রয়েছে। তবে, এখানকার স্বাস্থ্যকর স্যানিটেশন ব্যবস্থা কিছুটা উন্নতির দিকে রয়েছে, এবং এই অঞ্চলের গ্রামীণ জনগণের জন্য আরও স্বাস্থ্যসেবা বৃদ্ধি করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
উপসংহার: মঠবাড়ীয়া উপজেলা তার সমৃদ্ধ ইতিহাস, সংস্কৃতি, কৃষি, শিক্ষা ও স্বাধীনতা সংগ্রামের ঐতিহাসিক অবদানে ভরপুর। এখানকার জনগণ তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও ইতিহাসের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাশীল এবং দেশ-বিদেশে তাদের কর্মজীবনে সুনাম অর্জন করছেন। এই উপজেলা বাংলাদেশের ইতিহাস ও সমাজে একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে।
আপনার মতামত লিখুন :