জুলাই অভ্যুত্থানের পর ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটলেও দেশের বাজার ব্যবস্থাপনায় তেমন কোনো পরিবর্তন দেখা যায়নি। গত পাঁচ মাস ধরে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে থাকলেও তার রেখে যাওয়া সিন্ডিকেট আগের মতোই সক্রিয়। বাজার থেকে পরিবহন সেক্টর এবং প্রশাসন সর্বত্রই চলছে সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণ। এই পাঁচ মাসে শুধুমাত্র দলের পরিবর্তনই হয়েছে। আগে যেখানে আওয়ামী লীগের নেতারা সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করতেন, সেখানে এখন বিএনপি বা অন্যান্য দলের নেতারা সেই স্থান দখল করেছেন।
এ পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের দুর্দশা বেড়েই চলেছে। আমনের ভরা মৌসুমেও চালের দাম কমেনি বরং বেড়েছে। বিশ্ববাজারে চাল, চিনি, মাছ এবং পোল্ট্রি ফিডের দাম কমলেও দেশের বাজারে এর কোনো প্রতিফলন নেই। যার ফলে ডিম, মুরগি ও মাছের দাম কমার সম্ভাবনাও ক্ষীণ।
সিন্ডিকেট সক্রিয়তার স্বীকৃতি
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার স্বীকার করেছেন যে বাজারের সিন্ডিকেট এখনো সক্রিয়। তিনি জানিয়েছেন, "হাত বদলের মাধ্যমে দাম বাড়ছে। আমরা চেষ্টা করছি এটি নিয়ন্ত্রণ করতে।" তবে এই চেষ্টা কার্যত ব্যর্থ হয়েছে এবং মানুষের মধ্যে হতাশা ক্রমেই বাড়ছে।
গণতান্ত্রিক প্রত্যাশা পূরণের ব্যর্থতা
১৬ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসানের পর জনগণের মনে নতুন প্রত্যাশা জন্মেছিল। কিন্তু সিন্ডিকেটের কারণে চাল, ডাল, তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়ায় সেই প্রত্যাশা হতাশায় রূপ নিয়েছে। গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি এবং গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর এই পরিস্থিতিকে অন্তরবর্তীকালীন সরকারের ব্যর্থতা বলে উল্লেখ করেছেন।
জোনায়েদ সাকি বলেছেন, "সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে কঠোর পদক্ষেপ প্রয়োজন, যা বর্তমান সরকার নিতে পারছে না।" অপরদিকে নুরুল হক নুর বলেছেন, "শেখ হাসিনার দোসররা পালিয়ে যাওয়ার পর নতুন মাফিয়া সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করছে।"
সরকারি উদ্যোগ ও সীমাবদ্ধতা
ভোক্তা অধিদপ্তর ৫৮ জন কর্মকর্তার নেতৃত্বে দেশব্যাপী অভিযান পরিচালনা করলেও সিন্ডিকেট সক্রিয় রয়েছে। ক্যাব-এর সিনিয়র সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেছেন, "সিন্ডিকেট ও মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে নিম্ন আয়ের মানুষ চরম কষ্টে আছে। অনেকে কম খেয়ে কেবল টিকে থাকার চেষ্টা করছেন।"
জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পরিচালক মোহাম্মদ আলীম আখতার খান জানান, "আমরা বাজার সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছি এবং সংশ্লিষ্টদের একাংশকে চিহ্নিত করেছি।" তবে এখনো কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হয়নি।
কৃষকদের ক্ষতি ও বাজার ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতা
শীতকালীন সবজির দাম উৎপাদক পর্যায়ে অত্যন্ত কম হলেও ভোক্তা পর্যায়ে তিনশ গুণ পর্যন্ত বেশি। কৃষকরাও তাদের পণ্যের ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন না। পোলট্রি ফিডের মূল্যবৃদ্ধির কারণে ডিম ও মুরগির উৎপাদন খরচ বেড়েছে। বাংলাদেশে এক দিন বয়সী মুরগির বাচ্চার দাম ভারত ও পাকিস্তানের তুলনায় অনেক বেশি। পোলট্রি খাদ্য শিল্পের সিন্ডিকেটের সঙ্গে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের যোগসাজশের অভিযোগও উঠেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সুমন হাওলাদার বলেন, "ভারতে ডিমের উৎপাদন খরচ ৫ টাকা হলে বাংলাদেশে তা সাড়ে ১০ টাকা কেন হবে? পোলট্রি খাদ্যের সিন্ডিকেটের কারণেই এই ব্যয় বেশি।" অন্যদিকে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তবে পোলট্রি ফিডের বাজার সিন্ডিকেট নিয়ে তদন্তের দাবি ক্রমেই জোরালো হচ্ছে।
শেষ কথা
অন্তরবর্তীকালীন সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণের অনেক আশ্বাস দিলেও বাস্তবে তেমন কোনো কার্যকর উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। সিন্ডিকেটের কারণে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েই চলেছে। উৎপাদকরা ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, আর ভোক্তারা উচ্চমূল্যের শিকার হচ্ছেন। সরকারের উচিত সিন্ডিকেট ভেঙে দিয়ে ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার মাধ্যমে জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনা।
আপনার মতামত লিখুন :