কুয়ালালামপুরসহ দেশের বিভিন্ন প্রদেশে অবৈধ অভিবাসীদের চিহ্নিত করতে ধারাবাহিক অভিযান চালাচ্ছে অভিবাসন বিভাগ। এই অভিযানের কারণে বৈধ ও অবৈধ উভয় প্রবাসীদের জন্য সময়টা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। চলতি জানুয়ারির শুরু থেকে এখন পর্যন্ত সাত শতাধিক অবৈধ প্রবাসী আটক হয়েছেন, যাদের মধ্যে প্রায় আড়াই শতাধিক বাংলাদেশি।
অভিযানের উদ্দেশ্য এবং প্রক্রিয়া
মালয়েশিয়ার অভিবাসন বিভাগ জানিয়েছে, অবৈধ অভিবাসীদের অবস্থান ও কার্যক্রম চিহ্নিত করতে দেশজুড়ে বিশেষ অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। বিভিন্ন স্থানে বিদেশি নাগরিকরা অবৈধভাবে বসবাস ও ব্যবসা পরিচালনা করছে এমন তথ্যের ভিত্তিতে অভিযানগুলো পরিচালিত হচ্ছে।
সম্প্রতি কুয়ালালামপুরের পেটালিং স্ট্রিট এলাকায় ‘কেএল স্ট্রাইক ফোর্স’ নামে একটি বিশেষ অভিযান চালানো হয়। এই অভিযানে প্রায় এক ঘণ্টার বেশি সময় ধরে ৭৭ জন বিদেশি নাগরিককে তল্লাশি করা হয়। এদের মধ্যে যাদের বৈধ কাগজপত্র নেই, এমন ৩৪ জনকে আটক করা হয়েছে।
আটকদের মধ্যে ২৬ জন বাংলাদেশি, চারজন মিয়ানমারের নাগরিক, দুইজন পাকিস্তানি এবং মরিশাস ও নেপালের নাগরিক রয়েছেন। এদের বয়স ২২ থেকে ৫৫ বছরের মধ্যে। আটক ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অভিযোগের মধ্যে রয়েছে পাসের অপব্যবহার, নির্ধারিত কর্মস্থলে অনুপস্থিতি এবং অননুমোদিত স্থানে কাজ করা।
সাম্প্রতিক প্রেক্ষাপট
২০২৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত মালয়েশিয়ার সরকার সাধারণ ক্ষমার মেয়াদ ঘোষণা করেছিল। এই সময়ের মধ্যে যেসব অবৈধ অভিবাসী দেশে ফেরত যেতে চেয়েছিলেন, তাদের জন্য কাগজপত্রহীন থাকার দায়ে শাস্তি এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ ছিল। তবে মেয়াদ শেষ হওয়ার পর থেকে অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে অভিযান আরও কঠোরভাবে পরিচালিত হচ্ছে।
মালয়েশিয়ার অভিবাসন বিভাগের কুয়ালালামপুর পরিচালক ওয়ান মোহাম্মদ সৌপি ওয়ান ইউসুফ জানান, বৈধ কাজের ভিজিট পাস এবং ওয়ার্ক পারমিট থাকা সত্ত্বেও যেসব বিদেশি নাগরিক নির্ধারিত নিয়োগকর্তা বা কর্মস্থল থেকে বাইরে কাজ করছেন, তারাও এই অভিযানের আওতায় পড়ছেন। এদের বেশিরভাগই নির্মাণ, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং অন্যান্য খাতে কাজ করছেন।
অভিবাসনের কারণ ও গুরুত্ব
মালয়েশিয়া দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তি হওয়ায় বিদেশি অভিবাসীদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ গন্তব্য। দেশটির কৌশলগত ভৌগোলিক অবস্থান, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং বিভিন্ন খাতে কাজের সুযোগ বিদেশিদের মালয়েশিয়ায় আসার প্রতি আকর্ষণ বাড়িয়েছে।
নির্মাণ, বৃক্ষরোপণ, উৎপাদন এবং পরিষেবা খাতগুলোতে বিদেশি শ্রমিকের ওপর মালয়েশিয়ার অত্যন্ত নির্ভরশীলতা রয়েছে। স্থানীয় শ্রমিকদের মধ্যে এসব সেক্টরে কাজ করার আগ্রহ কম থাকায় বিদেশি শ্রমিকরা দেশটির অর্থনীতির একটি অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠেছেন।
তবে অবৈধ অভিবাসন মালয়েশিয়ার জন্য একটি বড় সামাজিক ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ। অনুমান করা হয়, মালয়েশিয়ায় ২ থেকে ৪ মিলিয়ন অবৈধ অভিবাসী কাজ করছে, যা দেশের নিরাপত্তা ও সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
চ্যালেঞ্জ এবং সমাধান
অবৈধ অভিবাসীদের উপস্থিতি শুধু সামাজিক নিরাপত্তার জন্য হুমকি নয়, বরং স্থানীয় কর্মসংস্থানেও প্রভাব ফেলে। বিদেশি শ্রমিকদের নিম্ন মজুরিতে নিয়োগ দেওয়া হয়, যা স্থানীয় শ্রমিকদের জন্য কাজের সুযোগ সীমিত করে।
অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৈধ এবং অবৈধ অভিবাসীদের নিয়ে মালয়েশিয়াকে আরও সুসংহত ব্যবস্থাপনা প্রণয়ন করতে হবে। ই-ওয়ার্ক সিস্টেম চালুর মাধ্যমে নিয়োগকর্তাদের আরও স্বচ্ছ পদ্ধতিতে বিদেশি কর্মীদের নিবন্ধন করতে উৎসাহিত করা প্রয়োজন।
মালয়েশিয়া সরকার বিদেশি অভিবাসীদের শোষণ রোধে এবং মানবপাচার প্রতিরোধে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে। আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে অভিবাসীদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন বা বৈধকরণের প্রক্রিয়া আরও সহজ করা সম্ভব।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
মালয়েশিয়ার অর্থনৈতিক চাহিদা ও স্থানীয় সম্প্রদায়ের কল্যাণের মধ্যে ভারসাম্য আনতে একটি কার্যকর অভিবাসন নীতিমালা অত্যন্ত জরুরি। সরকার অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর পাশাপাশি বিদেশি শ্রমিকদের ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা আনতে কাজ করছে।
অভিবাসন ইস্যুতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে একটি দীর্ঘমেয়াদি সমাধান নিশ্চিত করা সম্ভব। মালয়েশিয়ার অভিবাসন ইস্যুটি শুধু দেশটির জন্যই নয়, বরং গোটা অঞ্চলের জন্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
আপনার মতামত লিখুন :