বাংলাদেশ রবিবার, ২৬ জানুয়ারি, ২০২৫, ১৩ মাঘ ১৪৩১

সচিবালয়ের গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র পুড়ে ছাই: অগ্নিকাণ্ড নাকি নাশকতা?

দৈনিক প্রথম সংবাদ ডেস্ক

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ২৭, ২০২৪, ১০:১৫ এএম

সচিবালয়ের গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র পুড়ে ছাই: অগ্নিকাণ্ড নাকি নাশকতা?

সচিবালয়ের অগ্নিকাণ্ডে নাশকতার গন্ধ। ছবি: সংগৃহীত

দেশের প্রশাসনিক প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় জনমনে বিরাজ করছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। রাজধানী ঢাকায় মধ্যরাতে সুউচ্চ ভবনের তিনটি স্থানে একসঙ্গে আগুন লাগার ঘটনায় নাশকতার সন্দেহ প্রবল। সরকারের উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত কমিটি ইতোমধ্যে কাজ শুরু করলেও এটি নিছক দুর্ঘটনা নাকি ষড়যন্ত্র, তা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন উঠেছে। অগ্নিকাণ্ডে বহু গুরুত্বপূর্ণ সরকারি নথিপত্র পুড়ে গেছে, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।

অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয় বুধবার দিবাগত রাত ১টা ৫২ মিনিটে। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা প্রায় ১০ ঘণ্টার চেষ্টায় সকাল ১১টা ৪৫ মিনিটে আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনেন। আগুনে ৭ নম্বর ভবনের ছয় থেকে নয়তলা পর্যন্ত চারটি ফ্লোর সম্পূর্ণ পুড়ে গেছে। এসব ফ্লোরে ছিল অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, ডাক ও টেলিযোগাযোগ, তথ্যপ্রযুক্তি, শ্রম ও কর্মসংস্থান, যুব ও ক্রীড়া, এবং সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ দফতর।

অগ্নিকাণ্ডের ধরন এবং সময় নিয়ে বিশেষজ্ঞরা একে পরিকল্পিত নাশকতা বলে মনে করছেন। সাবেক ফায়ার সার্ভিস মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ইঞ্জিনিয়ার আলী আহমেদ খান জানিয়েছেন, শর্টসার্কিট থেকে আগুন লাগলে একসঙ্গে তিন-চার জায়গায় আগুন লাগার সম্ভাবনা কম। বিশেষজ্ঞরা রিমোট কন্ট্রোল, ড্রোন কিংবা দুর্বৃত্তদের পরিকল্পিত চক্রান্তের আশঙ্কা করছেন।

অগ্নিকাণ্ডের পেছনে ষড়যন্ত্রের সম্ভাবনা

রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই অগ্নিকাণ্ড অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রম ব্যাহত করার উদ্দেশ্যে ঘটানো হতে পারে। সরকারের মন্ত্রী আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেন, “আমাদের ব্যর্থ করার ষড়যন্ত্রে জড়িতদের বিন্দুমাত্র ছাড় দেওয়া হবে না।”

ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা জানান, আগুন নেভাতে গিয়ে তারা নানা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়েছেন। সচিবালয়ের সরু প্রবেশপথে ফায়ার ট্রাক প্রবেশ করাতে সমস্যা হয়েছে, যা আগুন নেভানোর কাজে দেরি ঘটিয়েছে। এছাড়া ভবনের ভেতরের সিসিটিভি ক্যামেরাগুলো কার্যকর ছিল না, যা আগুনের রহস্য উদঘাটনে বড় বাধা সৃষ্টি করছে।

গোয়েন্দা তৎপরতা ও তদন্ত কমিটির কার্যক্রম

অগ্নিকাণ্ডের পর থেকে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো সচিবালয়ের ভেতরে ও আশপাশের এলাকায় তৎপরতা চালাচ্ছে। ইতোমধ্যে তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ খালেদ রহীমের নেতৃত্বে একটি কমিটি তিন দিনের মধ্যে প্রাথমিক প্রতিবেদন জমা দেবে।

তবে তদন্তে অনেক অজানা তথ্য সামনে আসতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। সাবেক ফায়ার সার্ভিস মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবু নাঈম মো. শাহিদউল্লাহ বলেন, “এই আগুনকে স্যাবোটাজ হিসেবে ধরে নিয়ে তদন্ত না করলে ভুল হবে।”

জনমনে প্রশ্ন ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার দুর্বলতা

সচিবালয়ের মতো কেপিআইভুক্ত স্থানে কীভাবে এমন ঘটনা ঘটল, তা নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভ ও বিস্ময় বিরাজ করছে। ভবনের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা কর্মীদের ভূমিকা এবং ফায়ার সার্ভিসের আগুন নেভানোর প্রস্তুতির ঘাটতি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ফায়ার সার্ভিস কর্মী মো: সোয়ানুর জামান নয়ন নিহত হয়েছেন। ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জাহেদ কামাল এ ঘটনায় গভীর শোক প্রকাশ করেন এবং দ্রুত অগ্নিকাণ্ডের কারণ উদঘাটনের আশ্বাস দেন।

এই ঘটনায় দেশের গুরুত্বপূর্ণ দফতরের নথিপত্রের ক্ষতি হওয়ায় সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড প্রভাবিত হতে পারে। রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক মহল এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছেন এবং দ্রুত তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত অপরাধীদের শনাক্ত করার দাবি তুলেছেন।

উপদেষ্টাদের বক্তব্য

সচিবালয়ের অগ্নিকাণ্ড নিয়ে উপদেষ্টাদের বক্তব্যগুলোতে ষড়যন্ত্রের আশঙ্কা এবং সরকারের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত নাশকতার ইঙ্গিত স্পষ্ট। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া এই ঘটনাকে সরকারের ব্যর্থতার জন্য ষড়যন্ত্রমূলক পদক্ষেপ বলে উল্লেখ করেছেন। তার মতে, "আমাদের ব্যর্থ করার ষড়যন্ত্রে জড়িতদের বিন্দু পরিমাণ ছাড় দেওয়া হবে না।"

অন্যদিকে, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী জানিয়েছেন যে এই ঘটনায় উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে। তবে তিনি সতর্ক করেছেন যে, তদন্ত শেষ হওয়ার আগে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানো ঠিক হবে না।

জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক সারজিস আলমও এই অগ্নিকাণ্ডকে ষড়যন্ত্রমূলক উল্লেখ করেছেন। তার মতে, এটি পরিকল্পিতভাবে সরকারের তদন্ত কাজে গুরুত্বপূর্ণ নথি পুড়িয়ে দেওয়ার জন্য ঘটানো হতে পারে। তিনি বলেন, "আমাদের জায়গা থেকে মনে করি, ষড়যন্ত্র করে, পরিকল্পনা করে এই আগুনটি লাগানো হয়েছে।"

মোটের ওপর, উপদেষ্টাদের বক্তব্যে পরিষ্কার যে এই অগ্নিকাণ্ড নিছক দুর্ঘটনা নয়। বরং এটি পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের ফল হতে পারে বলে তারা মনে করছেন। এ বিষয়ে সরকার এবং জনগণকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানানো হয়েছে।

 

Link copied!

সর্বশেষ :