বাংলাদেশ থেকে রাশিয়ায় মানব পাচারে জড়িত অভিযোগে এক নারীকে গ্রেপ্তারের কথা জানিয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। ঢাকায় হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। সিআইডি জানিয়েছে, ওই নারী মানব পাচার চক্রের সদস্য। ওই চক্র ১০ বাংলাদেশিকে রাশিয়ায় নিয়ে গিয়ে এক সুলতানের কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন।
এই ঘটনাটি মানব পাচারের ভয়াবহ বাস্তবতা এবং আন্তর্জাতিক সংঘাতের শিকার হওয়া সাধারণ মানুষের দুর্দশার একটি চরম দৃষ্টান্ত। বাংলাদেশ থেকে রাশিয়ায় চাকরির প্রলোভনে মানব পাচারের এই চক্র কেবল আর্থিক প্রতারণাই করেনি, বরং মানুষকে সরাসরি যুদ্ধের ময়দানে ঠেলে দিয়েছে, যা একটি গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন।
সিআইডির অনুসন্ধান অনুযায়ী, মানব পাচারকারী চক্রটি ‘ড্রিম হোম ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরস লিমিটেড’ নামে একটি এজেন্সির মাধ্যমে বাংলাদেশি নাগরিকদের উচ্চ বেতনের চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে প্রথমে সৌদি আরবে পাঠায়। ওমরাহ পালনের সুযোগ দিয়ে তাদের বিশ্বাস অর্জন করা হয়, এরপর রাশিয়ায় নিয়ে গিয়ে এক সুলতানের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়। এই সুলতান পরবর্তীতে তাদের দাস হিসেবে সামরিক বাহিনীর হাতে তুলে দেন, যেখানে তাদের সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে ইউক্রেন যুদ্ধে পাঠানো হয়।
এই পাচারের শিকার হয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানো ১০ জনের মধ্যে ইতোমধ্যেই একজন নিহত এবং একজন গুরুতর আহত হয়েছেন। নাটোরের সিংড়া উপজেলার হুমায়ুন কবির যুদ্ধে মারা যান, আর ঢাকার কেরানীগঞ্জের আমিনুল গুরুতর আহত হয়ে দেশে ফেরার চেষ্টা করছেন। নরসিংদীর আকরাম হোসেন নামের একজন প্রশিক্ষণ ক্যাম্প থেকে পালিয়ে নিজ ব্যবস্থায় দেশে ফিরে আসতে সক্ষম হয়েছেন।
এই চক্রের দ্বিতীয় একটি দল বর্তমানে সৌদি আরবে আটকা পড়েছে। যুদ্ধে যাওয়ার বিষয়টি জানতে পেরে তারা রাশিয়ায় যেতে অস্বীকৃতি জানান। ফলে পাচারকারীরা তাদের পাসপোর্ট কেড়ে নেয়, যার ফলে তারা সৌদি আরবে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন। কাজ করতে পারছেন না, দেশে ফিরতেও পারছেন না। সিআইডি জানিয়েছে, এই বাংলাদেশিদের দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে।
এই চক্রের মূল হোতা তামান্না এবং তার ভাই তুহিন। তামান্না বাংলাদেশে মানব পাচারের সমন্বয়কারী হিসেবে কাজ করছিলেন, এবং তার ভাই তুহিন রাশিয়ায় অবস্থান করে সাধারণ মানুষকে যুদ্ধে যেতে উৎসাহিত করতেন। তামান্নাকে ইতোমধ্যেই ঢাকার শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, যখন তিনি নেপালে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন।
এই ঘটনা থেকে বোঝা যায়, মানব পাচারের ভয়াবহতা কত গভীর হতে পারে। এটি কেবল অর্থনৈতিক প্রতারণার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং মানুষের জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলে দাসত্ব ও সংঘাতে ঠেলে দেওয়ার মতো ভয়ংকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে।
বাংলাদেশ সরকার এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে, কারণ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এমন মানব পাচারের শিকার হওয়া মানুষদের নিরাপদে দেশে ফিরিয়ে আনা এবং এই চক্রের মূল অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা জরুরি।
ভবিষ্যৎ করণীয়
- মানব পাচার প্রতিরোধে কঠোর আইন প্রয়োগ: সরকারের উচিত এই ধরনের প্রতারণামূলক চাকরির বিজ্ঞাপন দেওয়া ট্র্যাভেল এজেন্সিগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং বিদেশগামী কর্মীদের সঠিক যাচাই-বাছাই করা।
- সচেতনতা বৃদ্ধি: সাধারণ জনগণকে এই ধরনের প্রতারণার ফাঁদ সম্পর্কে আরও বেশি সচেতন করা জরুরি।
- আন্তর্জাতিক সহযোগিতা: সৌদি আরব ও রাশিয়ার সঙ্গে কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে আটকে পড়া বাংলাদেশিদের দ্রুত দেশে ফেরানোর উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।
এই ঘটনা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারে এবং বাংলাদেশ সরকারের জন্য এটি দ্রুত সমাধান করা গুরুত্বপূর্ণ।
আপনার মতামত লিখুন :