বাংলাদেশ রবিবার, ১৬ মার্চ, ২০২৫, ২ চৈত্র ১৪৩১

সেন্টমার্টিন দ্বীপ নিয়ে পর্যটন সন্দেহ ও বাস্তবতা

দৈনিক প্রথম সংবাদ ডেস্ক

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১২, ২০২৫, ১১:৪৩ এএম

সেন্টমার্টিন দ্বীপ নিয়ে পর্যটন সন্দেহ ও বাস্তবতা

সেন্টমার্টিন দ্বীপ

সেন্টমার্টিন দ্বীপ, বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর ও আকর্ষণীয় পর্যটন স্থানগুলির মধ্যে একটি, যা দেশের দক্ষিণাঞ্চলে বঙ্গোপসাগরের মধ্যে অবস্থিত। ৮ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এ দ্বীপটি বিশ্বের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ হিসেবে পরিচিত। 

সেন্টমার্টিনে প্রায় দশ হাজার মানুষ বাস করে, তবে পর্যটন বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে প্রতিবছর সেখানে কয়েক লাখ মানুষের আগমন ঘটে। এতে দ্বীপের পরিবেশ এবং জীববৈচিত্র্যের ওপর চাপ পড়ছে। পাশাপাশি, বিভিন্ন গুজব এবং রাজনৈতিক বিতর্ক সেন্টমার্টিনকে ঘিরে ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে, যার ফলে দ্বীপটির ভবিষ্যৎ নিয়ে মানুষের মধ্যে নানা সন্দেহ তৈরি হয়েছে।


প্রতিবছর সেন্টমার্টিনে লাখ লাখ পর্যটক যাতায়াত করে, যা দ্বীপটির জীববৈচিত্র্য এবং পরিবেশের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। বিশেষ করে, দ্বীপের প্রবাল প্রাচীরের অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে। ২০২৪ সালের এপ্রিলে Environmental Advances নামক বিজ্ঞান সাময়িকীতে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে বলা হয়, পর্যটনের কারণে দ্বীপে তাপমাত্রা বৃদ্ধি, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, বন উজাড়, দূষণ, এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে। এসব কারণে দ্বীপটির প্রবাল শিলা ধ্বংস হচ্ছে এবং কচ্ছপসহ অন্যান্য জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে। এমনকি, সেন্টমার্টিনে মিঠা পানির সংকটও সৃষ্টি হচ্ছে, যার কারণে স্থানীয় জনগণের জীবনযাত্রা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে।

এছাড়াও, দ্বীপের প্রাকৃতিক পরিবেশের ক্ষতির কারণে প্রতিবছর সেন্টমার্টিনে সমুদ্র ভাঙনও বেড়ে যাচ্ছে, যা দ্বীপটির অস্তিত্বের জন্য বিপদজনক। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে Ocean Science জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়, সেন্টমার্টিনের ৪১ শতাংশ প্রবাল ইতিমধ্যে ধ্বংস হয়ে গেছে এবং ২০৪৫ সালের মধ্যে এটি পুরোপুরি প্রবাল শূন্য হতে পারে।


তবে, সেন্টমার্টিনের পরিবেশ রক্ষায় ২০২৪ সালের অক্টোবর মাসে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কিছু কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। ২০২৪ সালের নভেম্বর মাস থেকে সেন্টমার্টিনে রাত্রিযাপন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এছাড়াও, সেন্টমার্টিন ভ্রমণকারী পর্যটকদের সংখ্যা দৈনিক দুই হাজারের মধ্যে সীমাবদ্ধ করা হয়েছে এবং আগাম নিবন্ধন, ট্রাভেল পাস এবং জাতীয় পরিচয়পত্রের প্রদর্শন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এসব পদক্ষেপের মাধ্যমে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রবেশ রোধ করা সম্ভব হচ্ছে এবং দ্বীপের পরিবেশ সংরক্ষণে সহায়ক হচ্ছে।

তবে, ১ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত সেন্টমার্টিন ভ্রমণ পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এই সময়ে, পরিবেশ অধিদপ্তর দ্বীপের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেবে, যেমন প্লাস্টিক বোতল এবং ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার অভিযান, খাবার পানি উৎপাদন ও সরবরাহের জন্য বিশেষ প্রকল্পের বাস্তবায়ন, এবং বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থা চালু করা। এসব পদক্ষেপের মাধ্যমে সেন্টমার্টিনের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের আশা করা হচ্ছে।

দ্বীপটির জীববৈচিত্র্য এবং পরিবেশ


এছাড়াও, সেন্টমার্টিন নিয়ে বিভিন্ন সময়ে নানা গুজব ছড়ানো হয়েছে। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে একটি সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টে বলা হয়েছিল যে, মিয়ানমারের আরাকান আর্মি সেন্টমার্টিন দখল করে নিয়েছে। তবে, ফ্যাক্টচেক অনুসন্ধানী টিম রিউমার স্ক্যানার জানায় যে, এই দাবি সম্পূর্ণ মিথ্যা।

এছাড়া, আরও একটি গুজব ছড়ানো হয়েছিল যে, সেন্টমার্টিন দ্বীপ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ইজারা দেওয়া হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারিত এই অপপ্রচারটি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়, তবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এর বিরুদ্ধে স্পষ্ট জানিয়ে দেয় যে, সেন্টমার্টিনকে কোনো দেশের কাছে ইজারা দেওয়ার কোনো পরিকল্পনা নেই। সরকার এই বিষয়ে সিএ প্রেস উইং ফ্যাক্টস নামক ফেসবুক পেজে পরিষ্কার ঘোষণা দিয়েছে যে, সেন্টমার্টিন দ্বীপ কোনো বিদেশি রাষ্ট্রকে ইজারা দেওয়ার পরিকল্পনা সরকারের নেই।
সেন্টমার্টিন নিয়ে গুজব নতুন নয়। অতীতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে সেন্টমার্টিনকে নিয়ে নানা অভিযোগ উঠেছে। ২০১১ সালে শেখ হাসিনার সরকার গঠন করার পর থেকে সেন্টমার্টিন নিয়ে আলোচনার বিষয়টি নতুন করে শুরু হয়। তিনি একাধিকবার মন্তব্য করেছেন যে, সেন্টমার্টিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ইজারা দেওয়ার জন্য তার ওপর চাপ রয়েছে। তার এই মন্তব্যের পর বিভিন্ন মিডিয়া এবং রাজনৈতিক দলগুলো এ নিয়ে আলোচনা শুরু করে।

তবে, বাস্তবে সেন্টমার্টিন নিয়ে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের মধ্যে সামরিক প্রেক্ষাপটও রয়েছে। ২০১১ সালে বাংলাদেশ এবং যুক্তরাষ্ট্র যৌথ নৌ-মহড়া শুরু করে, যা এখনো চলমান। এই মহড়ায় দুটি দেশের নৌবাহিনী একসাথে কাজ করে, তবে এ ধরনের যৌথ মহড়া কোনো ধরনের সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের উদ্দেশ্যে নয়। ১৯৯১ সালে ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত উপকূলবাসীদের সাহায্যের জন্য মার্কিন সামরিক বাহিনী অপারেশন সি এঞ্জেল পরিচালনা করেছিল। তখনও সেন্টমার্টিন নিয়ে অপপ্রচার ছড়ানো হয়েছিল।


বাংলাদেশের সমুদ্রপথে মার্কিন নৌঘাঁটি স্থাপনের গুজবের কোনো ভিত্তি নেই। দক্ষিণ চীন সাগরের মতো এলাকায় চীনের শক্তি মোকাবিলার জন্য সিঙ্গাপুর এবং ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জে মার্কিন নৌঘাঁটি রয়েছে। চীনকে ঠেকানোর জন্য মালাক্কা প্রণালী এবং ভারত মহাসাগরের মধ্যবর্তী অঞ্চলে মার্কিন উপস্থিতি প্রয়োজন, তবে বঙ্গোপসাগরে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের কোনো যুক্তি নেই।


সেন্টমার্টিন দ্বীপ বাংলাদেশের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক সম্পদ। তবে, দ্বীপটির জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ রক্ষা অত্যন্ত জরুরি। সেন্টমার্টিনে পর্যটন ও গুজবের কারণে যা কিছু সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে, তার সমাধানে সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ প্রয়োজন। পাশাপাশি, জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি এবং সঠিক তথ্য প্রচার করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দ্বীপটির ভবিষ্যৎ রক্ষায় সরকারের পদক্ষেপ এবং জনসাধারণের সহযোগিতা অপরিহার্য।

Link copied!

সর্বশেষ :