ভাষা আন্দোলন বাংলাদেশের জাতীয় জীবনের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর বাংলার মানুষের ওপর বিভিন্ন দিক থেকে ভাষার প্রতি অবহেলা এবং নির্যাতন শুরু হয়, যা পরে একুশে ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলনে রূপ নেয়। এই আন্দোলন কেবল একটি ভাষার দাবির জন্য নয়, বরং বাঙালি জাতির জাতীয় মর্যাদা ও স্বাধীনতার পথে এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে গণ্য হয়। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ হওয়ার পর বাঙালি জাতি তার ভাষা এবং সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা আরও দৃঢ়ভাবে প্রকাশ করেছে।
১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর, পূর্ববঙ্গের বাঙালিরা দ্রুত বুঝতে পারেন যে, তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে পাকিস্তান সরকারের কোনো আগ্রহ বা শ্রদ্ধা নেই। পাকিস্তান সরকার মূলত উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করছিল, যা বাঙালি জনগণের জন্য এক সাংস্কৃতিক ও ভাষিক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়।
প্রথম দিকে, পাকিস্তান সরকার বাংলাকে কোনো গুরুত্ব না দিয়ে ইংরেজি এবং উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রাধান্য দিতে শুরু করে। সাধারণ মানুষের জন্য বেসিক যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে বাংলা বাদ দিয়ে উর্দু এবং ইংরেজি ব্যবহারের পক্ষে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এমনকি, সরকারি অফিসের ফরম, টেলিগ্রাম, পোস্টকার্ড, খাম এবং কাগজের টাকার নোটেও বাংলা বাদ দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়।
১৯৪৮ সালে, পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ যখন পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুকে প্রতিষ্ঠিত করার ঘোষণা দেন, তখন তা পূর্ববঙ্গের বাঙালির মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি করে। জিন্নাহ’র এই বক্তব্যে ক্ষিপ্ত হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা আন্দোলন শুরু করে। ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন সভায় জিন্নাহ ঘোষণা করেন, "উর্দু, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।" এর পরপরই ছাত্ররা প্রতিবাদে শামিল হয় এবং "নো, নো" ধ্বনিতে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়।

তবে ১৯৫০ সালের দিকে, পাকিস্তান সরকারের অসম্মানজনক আচরণের কারণে বাঙালি ছাত্ররা আরও তীব্রভাবে ভাষা আন্দোলনের পথ বেছে নেয়। তাদের প্রতিবাদ গড়েছিল সংগঠিত আন্দোলনে। বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন একত্রিত হয়ে “রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ” গঠন করে। ১৯৫১ সালের মার্চে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা আবারও সংঘবদ্ধ হয়ে আন্দোলন শুরু করে। তাদের মূল দাবি ছিল, বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা।
১৯৫১ সালের ১১ মার্চ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক ছাত্র সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভাটি কিছুটা মলিন হয়ে পড়েছিল, তবে এক ছাত্রের বক্তৃতা সভার মোড় ঘুরিয়ে দেয়। আবদুল মতিন, যিনি পরবর্তীতে ভাষা আন্দোলনের এক উল্লেখযোগ্য নেতা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন, তিনি ছাত্রদের বলেন, "বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য রাস্তায় আন্দোলন করতে হবে। শুধুমাত্র বক্তৃতা করে কোনো কাজ হবে না।" তার এই বক্তব্যে ছাত্রদের মধ্যে নতুন উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয় এবং তিনি আহ্বায়ক হিসেবে নির্বাচিত হন।
এ সময়, ভাষা আন্দোলনের প্রচারণা আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। মতিন এক প্রস্তাব গ্রহণ করে যে, ঢাকায় একটি পতাকা দিবস উদ্যাপন করা হবে, যাতে অর্থ সংগ্রহ করে আন্দোলনকে আরও শক্তিশালী করা যাবে। সে পরিকল্পনা অনুসারে ১৯৫১ সালে প্রথম পতাকা দিবস পালিত হয় এবং এর মাধ্যমে সংগঠনটি প্রথম আর্থিক সাহায্য সংগ্রহ করে।
একুশের ভাষা আন্দোলন একটি গণআন্দোলনে পরিণত হয়। ১৯৫২ সালের জানুয়ারিতে, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নাজিমউদ্দিন পল্টন ময়দানে এক জনসভায় ঘোষণা করেন, উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করা হবে। তার এই ঘোষণায় উত্তাল হয়ে ওঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা। ৩০ জানুয়ারি, ছাত্ররা প্রতীকী ধর্মঘট পালন করে এবং ১০-১৫ হাজার ছাত্র এই মিছিলে যোগ দেয়। ছাত্ররা সেদিন এক জোড়া লক্ষ্যে ছিল— বাংলা ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং পাকিস্তানে বাঙালি জনগণের মর্যাদা রক্ষা।
এ সময় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ গঠন করা হয়, যেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২ তারিখে, বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন ও সাধারণ জনগণ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জমায়েত হয় এবং তারা রাস্তায় নেমে আসে। সেই দিনের ঘটনার পর, বাংলা ভাষার দাবিতে আন্দোলন আরও তীব্র হয়ে ওঠে। একুশের অমর চেতনায় রক্তে রঞ্জিত হয়ে, ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউর, এবং আরও অনেক শহীদ। তারা চিরকাল বেঁচে থাকবে ভাষা আন্দোলনের অবিস্মরণীয় স্মৃতিতে।

এ আন্দোলন শুধুমাত্র ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা নয়, বরং একটি জাতির আত্মপরিচয় ও আত্মমর্যাদার সংগ্রাম ছিল। একুশের দিবস আজও আমাদের কাছে সেই আত্মত্যাগের প্রতীক, যে আত্মত্যাগের মাধ্যমে বাঙালি জাতি তার ভাষা ও সংস্কৃতির জন্য সংগ্রাম করেছিল।
এই আন্দোলন শেষ হয়নি। এটি বাঙালি জাতির জাতিসত্তার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সূত্রপাত ঘটায় এবং বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে যা সম্ভব হয়েছিল, তা একটি জাতির আত্মবিশ্বাস, মর্যাদা এবং স্বাধীনতার জন্য পথপ্রদর্শক হয়ে উঠেছিল।
আপনার মতামত লিখুন :