বাংলা নববর্ষ শুরু হয়। নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে ইতিমধ্যেই প্রস্তুত বাঙালি। মঙ্গলশোভা যাত্রার মধ্য দিয়ে বাংলায় নববর্ষ উদযাপিত হয়। লাল-সাদা রঙের মতো রঙিন পোশাক পরে হাজার হাজার বাঙালি অংশ নেয় এই অনুষ্ঠানে। পুরাতনকে বিদায় জানাই এবং বাংলা নববর্ষ ১৪৩১ কে বরণ।
নতুন বছর বরণের এই উত্সবকে হালখাতার উত্সব, পান্তার উত্সবও বলা হয়। কারণ এই দিনে হালখাতা খোলা আর পান্তা ইলিশ খাওয়ার চল রয়েছে। নতুন বছরে এসব নিয়েই থাকে বাড়তি উত্তেজনা। বিশেষ করে খাবারে পান্তা ইলিশ তো থাকা চাই। সেই সঙ্গে নানা পদে ভর্তা। বাঙালিয়ানা স্বাদ আনতে ঐতিহ্যবাহী মাটির সানকিতেই খাওয়া হয় পান্তা ইলিশ। রীতিমতো নিয়ম করেই খাওয়া হয় এটি। কেউ পান্তা ইলিশ খায়নি তো তার বর্ষবরণ হয়তো অপূরণই রয়ে গেল। বলা যায়, নববর্ষ উদযাপনের সঙ্গে এখন ওতোপ্রতোভাবে জড়িয়ে গেছে এই পান্তা ইলিশ।তবে আদৌ কি বাঙালির ইতিহাসে পান্তা ইলিশ খাওয়ার চল ছিল? গ্রাম বাংলার মানুষ কি পান্তা ইলিশ খেয়েই নতুন বছরের দিনটি শুরু করতেন? কী ছিল এর পেছনের গল্প?
ইতিহাস থেকে জানা যায়, বাঙালির নববর্ষ উদযাপনে পান্তা ভাত খাওয়ার চল ছিল বহুআগে থেকেই। পানিতে ভেজানো বাসি ভাতই হলো পান্তাভাত। গ্রাম বাংলার কৃষকরা গরমে-রোদে কাজ করতে যাওয়ার আগে পান্তাভাত খেয়ে নিতেন। শরীরকে ঠাণ্ডা রাখতেই তারা পান্তাভাত খেতেন। সূর্য ওঠার পরপরই পান্তাভাত খেয়ে তারা কাজে বের হতো। কাঁচামরিচ-পেঁয়াজ দিয়ে কিংবা কখনো কখনো পান্তাভাতের সঙ্গে বেগুনপোড়া বা আলুসেদ্ধ যুক্ত হতো। অনেকে শুধু পান্তার সঙ্গে লবণ মাখিয়েই খেয়ে নিতেন। আগের রাতেই ভাত ভিজিয়ে রাখা হতো। পরদিন সকালেই তা পান্তাভাত হয়ে যতে। ওই সময় মাটির হাঁড়ি থেকে পান্তাভাত তুলে নিয়ে কচুপাতায় বা কলাপাতায় রেখে খাওয়া হতো।
পান্তাভাতের সঙ্গে মাছের পদ খাওয়ার রীতি যোগ হয়েছে অনেক পরে। তাও আবার খাল বিলের মাছের তরকারি রান্না করেই পান্তাভাতের সঙ্গে খাওয়া হতো। কুচো চিংড়ি, ছোট ট্যাংরা, পুঁটি, টাকি মাছের তরকারি দিয়েই খাওয়া হতো পান্তাভাত। ওই সময় বিত্তবানদের বাড়িতে মাঝে মাঝে পান্তাভাত খাওয়া হতো। তবে তাও ছিল কুচো চিংড়ির তরকারি দিয়ে। চিংড়ি মাছের চচ্চ্ড়ির সঙ্গে পানতা ভাত খাওয়ার গল্প লিখেছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও।
তখন চিংড়ি ছিল সহজলভ্য মাছ। পান্থাওয়াতের সাথে চিংড়ির তরকারি জনপ্রিয় ছিল কারণ এটি ধনী এবং দরিদ্র উভয়ের কাছেই সহজলভ্য ছিল। এমনকি সে সময় পান্তাভাতের সঙ্গে ইলিশ খাওয়ার কোনো তথ্য ছিল না।কারণ ইলিশ বরাবরই খুব দামি মাছ ছিল। তাই ইলিশ গরম ভাতের সঙ্গেই খাওয়ার চল ছিল। কিন্তু পান্তার সঙ্গে ইলিশ খাওয়ার কোনো রীতি ছিল না ওই সময়।
এখন মনে প্রশ্ন আসতে পারে, তাহলে কি পান্তা ইলিশ খাওয়া বর্ষবরণ অংশ নয়? ইতিহাসে এর কোনো ভিত্তি নেই? মূলত আশির দশকে পান্তা ইলিশের চল আসে। ঢাকায় সর্বপ্রথম এই খাবারটি খাওয়ার চল শুরু হয়। ওই সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী অস্থায়ী দোকান দিয়ে পান্তাভাত আর ভাজা ইলিশ বিক্রি শুরু করেন। পান্তাভাত বাঙালির প্রাত্যহিক খাদ্য। অন্যদিকে ইলিশ বঙ্গ-উপকূলের মাছ। তাই এই দুই পদকে এক করে জাতীয়তাবাদী চেতনার সঙ্গে যুক্ত করেছেন তারা। যা দ্রুত দেশব্যাপী জনপ্রিয় হয়ে উঠে। পহেলা বৈশাখে অর্থাত্ নতুন বছরকে বরণ করতে পান্তা-ইলিশ খাওয়ার চল শুরু হলো। এর সঙ্গে কাঁচা মরিচ, পেঁয়াজ, আলুভর্তা, শুটকিভর্তা, বেগুনভর্তা ও পোড়া মরিচ তো থাকেই। পাত্র হিসেবে ব্যবহার করা হলো মাটির সানকি। নান্দনিক পরিবেশনায় খাবারটি দেশব্যাপী জনপ্রিয় হয়ে উঠে। ধীরে ধীরে বাংলা বর্ষবরণের নাগরিক রুচিতে ভর করে পান্তা-ইলিশ।
এরপরই ধীরে ধীরে রমনা বটমূলে বাঙালিরা এক হয়ে পান্তা ইলিশ খাওয়ার রীতি চালু করলো। আশির দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময় মঙ্গল শোভাযাত্রার শুরু হয়। সেই সূত্রে নগর মানুষ এক হতে থাকে বর্ষবরণের দিনটিতে। নানা আয়োজন জনপ্রিয় হতে থাকে। সেই সঙ্গে ভোজনরসিক বাঙালির কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠে পান্তা ইলিশ।
গ্রাম বাংলায় এখনও পান্তা খাওয়ার চল রয়েছে। তবে তারা নতুন বছরকে মিষ্টিমুখেই বরণ করে নেয়। আর বছরের শেষ দিনটিতে তিতা পদ খেয়ে বিদায় জানায়। তাদের ধারণা, তিতা খাবার খেলে পুরোনো বছরের দুঃখ-বেদনা বিসর্জন হয়ে যায়। আর নতুন বছরের শুরুতে মিষ্টিমুখ করলেই পুরো বছরটি সুখ শান্তিতেই কেটে যাবে।
আপনার মতামত লিখুন :