গাঢ় লাল বা গোলাপি রঙের এক রঙ্গিন সবজি বিটরুট, যা বর্তমানে খুবই সহজলভ্য এবং সারা বছরই বাজারে পাওয়া যাচ্ছে। এই বিটরুটের রয়েছে অসাধারণ পুষ্টিগুণ এবং ঔষধি গুণাবলি, যার কারণে এটি সুপারফুড হিসেবে পরিচিত। ভিটামিন, খনিজ এবং অ্যান্টি-অক্সিডেন্টে ভরপুর এই সবজি নিয়মিত খাদ্যতালিকায় রাখলে শরীর ও মন দুটোই সুস্থ থাকে। তবে কিছু বিশেষ অবস্থায় এটি খাওয়া একটু ঝুঁকিপূর্ণ। নিচে বিটরুটের পুষ্টিগুণ, উপকারিতা, খাওয়ার পদ্ধতি এবং খাওয়ার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সতর্কতা বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হলো।
বিটরুটের পুষ্টিগুণ
বিটরুটে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এবং খনিজ উপাদান। এতে আয়রন, জিংক, আয়োডিন, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, ফোলেট, ভিটামিন এ, ভিটামিন বি৬ এবং ভিটামিন সি রয়েছে। এছাড়া এটি আঁশ এবং অ্যান্টি-অক্সিডেন্টের চমৎকার উৎস। বিটে থাকা নাইট্রেট, বিটালাইনস এবং লুটেইন স্বাস্থ্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
বিটরুটের উৎপত্তি ও ইতিহাস
বিটরুট (Beta vulgaris) একটি পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ সবজি, যা প্রাচীন সময় থেকেই মানুষের খাদ্য ও ঔষধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এর শিকড় মূলত ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে পাওয়া গিয়েছিল এবং এটি ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে প্রচলিত ছিল। প্রাচীন মিশরীয়রা বিটরুটের শিকড়কে শক্তিশালী ঔষধি উপাদান হিসেবে ব্যবহার করতেন, বিশেষত রক্তস্বল্পতা এবং পাচনতন্ত্রের সমস্যা দূর করতে এটি কার্যকর ছিল। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বিটরুট খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে এবং পুষ্টিগুণের জন্য এখনো এটি বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত।
বাংলাদেশে বিটরুটের আগমন
বাংলাদেশে বিটরুটের আগমন খুব একটা প্রাচীন না হলেও বর্তমানে এটি সবার কাছে পরিচিত। প্রথমে এটি পশ্চিমা দেশগুলির খাদ্য সংস্কৃতি থেকে আসলেও, বিটরুটের অসাধারণ পুষ্টিগুণের কারণে এটি দেশে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে এখন এটি স্যুপ, স্মুদি, সালাদ, কেক এবং এমনকি বিভিন্ন ধরনের মিষ্টান্নে ব্যবহার হয়। আবহাওয়ার কারনে বাংলাদেশে সাধারণত শীতকালে বিটরুটের চাষ করা হয় এবং ভালো ফলন পাওয়া যায় বলে কৃষকরা এতে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন।
বিটরুটের চাষ ও ব্যবহার
বাংলাদেশে বিটরুট এখন স্থানীয় কৃষকদের কাছে একটি লাভজনক শস্য হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। শীতকালীন ফসল হিসেবে এটি চাষ করা হয় এবং এর মাটি ও আবহাওয়ার প্রতি বিশেষ কিছু চাহিদা রয়েছে। শীতল আবহাওয়া ও উর্বর মাটি বিটরুটের চাষের জন্য আদর্শ। কৃষকরা বিটরুট চাষে আগ্রহী হওয়ার কারন এর চাষ সহজ, তেমন কোনও বিশেষ যত্নের প্রয়োজন পড়ে না এবং এর পুষ্টিগুণও অত্যন্ত উচ্চমানের, যা স্বাস্থ্য সচেতন মানুষের জন্য উপকারী। বর্তমানে বিটরুট বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে চাষ করা হচ্ছে এবং এটি স্থানীয় বাজারে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
বিটরুট খাওয়ার উপকারিতা
১. উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ
বিটরুটে থাকা নাইট্রেট দেহে নাইট্রিক অক্সাইডে রূপান্তরিত হয়, যা রক্তনালীগুলোকে প্রশস্ত করে। ফলে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি হ্রাস পায়।
২. হজমশক্তি উন্নত করে
বিটরুটে রয়েছে প্রচুর আঁশ, যা হজমে সহায়তা করে। এটি কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধ করে এবং অন্ত্রের সুস্থতা বজায় রাখে।
৩. প্রদাহ কমায়
বিটরুটে বিটালাইন নামক প্রদাহবিরোধী উপাদান থাকে, যা শরীরে প্রদাহ সৃষ্টিকারী বিভিন্ন সমস্যার ঝুঁকি কমায়।
৪. শক্তি এবং কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি
অ্যাথলেট বা নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রমে যুক্ত ব্যক্তিদের জন্য বিটরুট খুব উপকারী। এটি শরীরের কোষে শক্তি উৎপাদন বৃদ্ধি করে এবং কর্মক্ষমতা বাড়ায়।
৫. মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি
বিটরুট মস্তিষ্কে রক্তপ্রবাহ বাড়ায়, যা স্মৃতিশক্তি ও মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা উন্নত করে। এটি বার্ধক্যের কারণে মস্তিষ্কের দুর্বলতা প্রতিরোধে সহায়তা করে।
৬. রক্তস্বল্পতা প্রতিরোধ
বিটরুটে থাকা আয়রন রক্তে হিমোগ্লোবিন তৈরি করে। এটি রক্তস্বল্পতার ঝুঁকি হ্রাস করে এবং রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে।
৭. ক্যানসার প্রতিরোধ
বিটরুটে থাকা অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট এবং বিটালাইন কোলন ক্যানসারের ঝুঁকি কমাতে সহায়তা করে।
৮. ত্বকের সৌন্দর্য বৃদ্ধি
বিটরুটের পুষ্টিগুণ ত্বক উজ্জ্বল করে এবং বার্ধক্যের ছাপ দূর করে।
৯. লিভার ডিটক্সিফিকেশন
বিটরুট শরীরের টক্সিন দূর করে এবং যকৃতের কার্যক্ষমতা উন্নত করে।
১০. মানসিক স্বাস্থ্য উন্নত করে
বিটরুটে থাকা বিটেইন এবং ট্রিপটোফোন মন ভালো রাখতে এবং মানসিক চাপ কমাতে সহায়তা করে।
বিটরুট খাওয়ার উপায়
বিটরুট বিভিন্ন উপায়ে খাওয়া যায়। এটি কাঁচা, রান্না করা, বা পানীয় হিসেবে গ্রহণ করা যায়। নিচে কিছু জনপ্রিয় এবং সহজ উপায় দেওয়া হলো:
১. কাঁচা বিটরুট
সালাদ: কাঁচা বিটরুট ছোট ছোট টুকরা করে সালাদে ব্যবহার করুন। এটি লেবুর রস, অলিভ অয়েল এবং কালো মরিচ দিয়ে মিশিয়ে খেলে খুবই সুস্বাদু হয়।
স্মুদি: কাঁচা বিটরুট, গাজর, আপেল, এবং এক চিমটি আদা দিয়ে ব্লেন্ড করে একটি স্বাস্থ্যকর স্মুদি তৈরি করা যায়।
২. রান্না করা বিটরুট
সিদ্ধ বিট: বিটরুটের খোসা ছাড়িয়ে পানি দিয়ে সিদ্ধ করে খাওয়া যায়। এটি সেদ্ধ অবস্থায় সালাদ বা অন্যান্য খাবারের সাথে খেতে উপযুক্ত।
ভাজা বিট: বিটরুট ছোট ছোট টুকরা করে সামান্য তেল, লবণ এবং মসলা দিয়ে বেক বা ভেজে খাওয়া যায়।
৩. বিটরুট জুস
বিটরুট জুস শক্তি বাড়াতে এবং শরীর ডিটক্সিফাই করতে কার্যকর। এক কাপ বিটরুটের সাথে এক কাপ গাজরের রস মিশিয়ে পান করলে এটি স্বাদে এবং পুষ্টিতে উন্নত হয়।
৪. স্যুপ বা কারি
বিটরুট দিয়ে স্যুপ তৈরি করা যায়। এটি লবণ, আদা এবং গোলমরিচ দিয়ে রান্না করলে স্বাদ এবং পুষ্টিগুণ দুটোই ভালো থাকে। সবজির কারি বা ডালের সাথে বিটরুট মিশিয়ে রান্না করা যায়।
৫. বিটরুট স্ন্যাকস
বিটরুট চিপস: পাতলা করে কাটা বিটরুট বেক করে স্বাস্থ্যকর চিপস তৈরি করা যায়।
বিটরুট পরোটা: বিটরুটের পেস্ট ময়দার সাথে মিশিয়ে পরোটা তৈরি করা যায়।
৬. মিষ্টান্ন ও ডেজার্টে ব্যবহার
বিটরুটের হালুয়া: গ্রেট করা বিটরুট দিয়ে হালুয়া তৈরি করা যায়।
কেক: বিটরুটের পেস্ট দিয়ে স্বাস্থ্যকর কেক বা ব্রাউনি বানানো যায়।
বিটরুটের অপকারিতা ও সতর্কতা
যদিও বিটরুটের উপকারিতা অনেক, তবুও নির্দিষ্ট কিছু শারীরিক অবস্থায় এটি খাওয়ার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকা জরুরি:
১. নিম্ন রক্তচাপ: বিটরুট রক্তচাপ আরও কমিয়ে দিতে পারে।
২. অ্যালার্জি: কারও কারও ক্ষেত্রে বিট খেলে ত্বকে চুলকানি বা ফুসকুড়ি হতে পারে।
৩. ডায়াবেটিস: বিটের গ্লাইসেমিক ইনডেক্স বেশি হওয়ায় এটি রক্তে শর্করার মাত্রা বাড়াতে পারে।
৪. কিডনিতে পাথর: বিটরুটে অক্সালেট বেশি থাকার কারণে কিডনিতে পাথর হওয়ার ঝুঁকি বাড়তে পারে।
৫. পর্যাপ্ত পরিমাণে খাওয়া: প্রতিদিন নিয়মিত বিট খাওয়া উচিত নয়। সপ্তাহে ৪-৫ দিন খাওয়া নিরাপদ।
উপসংহার
বিটরুট একটি পুষ্টিগুণে ভরপুর সবজি। এটি সঠিকভাবে এবং পরিমিত পরিমাণে খেলে শরীর সুস্থ থাকে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং ত্বক ও মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা উন্নত হয়। বিটরুট বিভিন্ন উপায়ে খাওয়ার মাধ্যমে খাদ্যতালিকায় বৈচিত্র্য আনা যায়। তবে কোনো শারীরিক সমস্যা থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে এটি খাদ্যতালিকায় যুক্ত করা উচিত।
আপনার মতামত লিখুন :