বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বাগেরহাট, খুলনা, নড়াইল, যশোর ও সাতক্ষীরা জেলার জনপ্রিয় একটি মশলা হলো চুইঝাল। এটি একটি লতা জাতীয় গাছ, যার কাণ্ড, পাতা, শিকড়, ফুল এবং ফল ঔষধি গুণসম্পন্ন। চুইঝাল বর্তমানে সারা দেশে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে এবং রান্নায় বিশেষ করে গরু ও হাঁসের মাংসের সঙ্গে ব্যবহৃত হয়।
চুইঝালের পরিচিতি ও উপাদানসমূহ
চুই লতার কাণ্ড ধূসর এবং পাতা দেখতে পান পাতার মতো। চুইঝালে রয়েছে ০.৭% সুগন্ধি তেল ও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রাসায়নিক উপাদান। যেমন:
১.আইসোফ্লাভোন ও অ্যালকালয়েডস: যা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে।
২.পিপারিন: যা চুইয়ের শিকড়ে ১৩.১৫% পরিমাণে থাকে।
৩.গ্লুকোজ, ফ্রুকটোজ, গ্লাইকোসাইডস: যা চুইঝালের ভেষজ গুণ বৃদ্ধি করে।
চুইঝালের উপকারিতা
চুইঝাল শুধু মশলা হিসেবে নয় এর রয়েছে নানা স্বাস্থ্যগত উপকারিতা।
১. রুচি বৃদ্ধি ও ক্ষুধামন্দা দূরীকরণ: চুইঝাল খাবারের রুচি বাড়াতে এবং ক্ষুধামন্দা দূর করতে কার্যকর।
২. ক্যান্সার প্রতিরোধ: চুইঝালের মধ্যে থাকা ফাইটোকেমিক্যাল উপাদান আইসোফ্লাভোন ক্যান্সার প্রতিরোধে ভূমিকা রাখে।
৩. হৃদরোগ প্রতিরোধ: কোলেস্টেরল কমিয়ে চুইঝাল হৃদরোগের ঝুঁকি হ্রাস করে।
৪. পাকস্থলীর সমস্যা দূর:
- গ্যাস্ট্রিক ও কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে সহায়তা করে।
- পাকস্থলীর প্রদাহ এবং অন্ত্রের সমস্যা নিরসনে কার্যকর।
৫. স্নায়ু ও মানসিক প্রশান্তি: মানসিক অস্থিরতা ও স্নায়ুর উত্তেজনা প্রশমিত করে।
৬. ব্যথা উপশম: এটি শরীরের বিভিন্ন ব্যথা উপশমে কার্যকর এবং শরীর সতেজ রাখতে সহায়তা করে।
৭. ঘুমের জন্য কার্যকর: চুইঝাল ঘুমের সমস্যা দূর করতে প্রাকৃতিক উপায় হিসেবে কাজ করে।
৮. প্রসব-পরবর্তী ব্যথা কমানো: সদ্য প্রসূতি মায়েদের জন্য এটি ব্যথা উপশমে অত্যন্ত কার্যকর।
৯. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি: ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাকজনিত রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে।
চুইঝাল এর কান্ড
চুইঝালের চাষাবাদ পদ্ধতি
জমি ও মাটি
চুই চাষের জন্য দো-আঁশ ও বেলে দো-আঁশ মাটি এবং পানি নিষ্কাশনের সুবিধাযুক্ত ছায়াময় উঁচু জমি সবচেয়ে উপযোগী। সাধারণ ফলবাগান বা বৃক্ষ বাগানের মাটি চুই চাষের জন্য বেশ উপযুক্ত।
রোপণের সময়
চুই লতা রোপণের উপযুক্ত সময় দুটি। যথা:
১. বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ (এপ্রিল-মে)
২. আশ্বিন-কার্তিক (অক্টোবর-নভেম্বর)
বংশবিস্তার পদ্ধতি
চুই লতার বংশবিস্তার হয় দুই ভাবে।যেমন:
১. বীজ দ্বারা: এই পদ্ধতি জটিল ও সময়সাপেক্ষ।
২. অঙ্গজ প্রজনন বা লতা কাটিং পদ্ধতি (সাধারণত ব্যবহৃত): ৫০-৭৫ সেমি লম্বা শাখা বা কাণ্ড (যাকে "পোড়" বলা হয়) কেটে সরাসরি মাটিতে রোপণ করা হয়। প্রতিটি পোড়ে ৪-৫টি পর্বসন্ধি থাকা প্রয়োজন। বাণিজ্যিকভাবে পলিব্যাগে চারা তৈরি করে পরে মূল জমিতে রোপণ করা যায়। লতা কাটিং পদ্ধতিতে গাছ দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং ফলনও তাড়াতাড়ি পাওয়া যায়।
কাটিং শোধন প্রক্রিয়া
রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণ প্রতিরোধে কাটিং শোধন করা গুরুত্বপূর্ণ। ১ লিটার পানিতে ২-৩ গ্রাম প্রোভ্যাক্স/নোইন/অটোস্টিন মিশিয়ে কাটিং ৩০ মিনিট ডুবিয়ে রাখতে হবে। এরপর পরিষ্কার পানি দিয়ে ধুয়ে কাটিং রোপণ করা উচিত।
সার ও সেচ ব্যবস্থাপনা
১. সার প্রয়োগ: রোপণের পূর্বে গর্তে পচা আবর্জনা বা ছাই ব্যবহার করা যায়। বর্ষার আগে ও পরে ইউরিয়া, টিএসপি, এবং এমওপি সার গাছের গোড়া থেকে ১ হাত দূরে প্রয়োগ করতে হবে।
২. সেচ: সপ্তাহে ১ বার সেচ দেওয়া উচিত। তবে বর্ষাকালে পানি জমে থাকার কারণে গাছ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, তাই পানি নিষ্কাশনের দিকে বিশেষ নজর রাখতে হবে।
চুই গাছ লাগানোর পদ্ধতি
১. গর্ত প্রস্তুতি: কাঠ জাতীয় গাছের গোড়া থেকে ১২-১৫ ইঞ্চি দূরে গর্ত তৈরি করুন। প্রতি গর্তে কিছু গোবর, পচা আবর্জনা, ৫০ গ্রাম ইউরিয়া, ৫০ গ্রাম টিএসপি, এবং ৫০ গ্রাম পটাশ মিশিয়ে ৭ দিন রেখে দিন।
২. রোপণ প্রক্রিয়া: কাটিং গর্তে লাগিয়ে খুঁটি ব্যবহার করে বড় গাছের সাথে বেঁধে দিন। ৩০-৪০ দিনের মধ্যে কাটিং গাছের কাণ্ড ধরে উপরে উঠতে শুরু করবে।
বাউনি দেওয়া
চুই লতা আরোহণের জন্য বড় গাছের সাপোর্ট প্রয়োজন। বাউনি হিসেবে ব্যবহৃত গাছ আম, জাম, সুপারি, নারিকেল, কাফলা ইত্যাদি। মাটিতে বাউনি ছাড়া বাড়লেও বর্ষাকালে গাছের ক্ষতির সম্ভাবনা বেশি থাকে।
ফসল সংগ্রহ
গাছ রোপণের ১ বছরের মাথায় খাওয়ার উপযোগী হয়। তবে ভালো ফলনের জন্য ৫-৬ বছরের গাছ উত্তম।
ফলন
হেক্টরপ্রতি চুইঝালের ফলন ২.০-২.৫ মেট্রিক টন। ৫-৬ বছরের একটি গাছ থেকে ১৫-২৫ কেজি।
এই পদ্ধতিতে চুই চাষ করলে গাছ দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং ভালো ফলন নিশ্চিত হয়।
অর্থনৈতিক সম্ভাবনা
চুইগাছের কাণ্ড, পাতা ও শিকড় চড়া দামে বিক্রি হয়। স্থানীয় বাজারে প্রতি কেজি চুই ৩০০-১২০০ টাকায় বিক্রি হয়। চুইঝাল শুধু দেশীয় চাহিদা মেটাচ্ছে না, এটি বিদেশেও রপ্তানি করা হচ্ছে। চুইঝাল চাষ করে দরিদ্র কৃষকেরা আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছেন। দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে চুইঝাল চাষ ভূমিকা রাখতে পারে।
উপসংহার
চুইঝাল একটি সম্ভাবনাময় অর্থকরী ফসল। এর ভেষজ গুণ ও আর্থিক সম্ভাবনা বিবেচনায় এর ব্যাপক চাষাবাদ শুরু করা উচিত। সঠিক পরিচর্যা ও উদ্যোগের মাধ্যমে এটি দেশের অর্থনীতি এবং স্বাস্থ্য খাতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে।
আপনার মতামত লিখুন :