প্রত্যেক ক্রিয়ারই সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে -- নিউটনের তৃতীয় এ সূত্রের মতোই যেন এক কঠিন বাস্তবের মুখোমুখি যুক্তরাষ্ট্র। দেশটি একদিকে ইসরাইলের হাতে অস্ত্র তুলে দিচ্ছে, অন্যদিকে গাজায় ত্রাণ পাঠিয়ে সবাইকে খুশি করার কৌশল নিয়েছে। আদতে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার এ চেষ্টা তাদের কাজে আসেনি। আর এসব কিছুর মধ্য দিয়ে পাল্টে গেছে মার্কিন রাজনীতির প্রেক্ষাপট, ভোটের সমীকরণ; যার পেছনে বড় ভূমিকা রাখছেন মুসলিমরা।
শুধু গাজা ইস্যুতেই যে মুসলমানরা বাইডেন প্রশাসনের ওপর ক্ষুব্ধ তা নয়; বর্ণবাদ, বৈষম্য, বিশ্বাসহীনতা থেকে শুরু করে নানা ইস্যুতে ধীরে ধীরে ওয়াশিংটনের দিকে থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করেছে মুসলিম বিশ্ব। দীর্ঘদিন ধরে জমতে থাকা ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে কেবল গাজায় যুদ্ধ শুরুর পর।
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের মতে, মুসলমানরা কেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন সেই প্রশ্নের উত্তর বেশ জটিল এবং বহুমুখী। সংবেদনশীলতার কথা মাথায় রেখেই বিষয়টি বোঝা জরুরি; কারণ এক্ষেত্রে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এবং কারণগুলো ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হতে পারে।
বিভিন্ন গবেষণায় ইঙ্গিত দেয়া হচ্ছে যে, যুক্তরাষ্ট্রে মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, আর প্রাথমিকভাবে এর পেছনে রয়েছে অভিবাসন এবং অন্য ধর্মের তুলনায় মুসলমানদের মধ্যে উচ্চ জন্মহার।জনসংখ্যার এ বৃদ্ধি সত্ত্বেও, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মুসলমানরা বৈষম্য এবং তাদের নিয়ে অনেকের নেতিবাচক ধারণাসহ বহু চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছেন। বিশেষ করে নাইন ইলেভেনের পর এ চ্যালেঞ্জ আরও বেড়েছে।
পিউ রিসার্চ সেন্টারের তথ্য বলছে, অনেক আমেরিকান মুসলিম সন্দেহ থেকে শুরু করে শারীরিক আক্রমণ পর্যন্ত নানা বৈষম্যের সম্মুখীন হয়েছে এবং গেল কয়েক বছর ধরেই তাদের এ ধরনের অভিজ্ঞতার মধ্যদিয়ে যেতে হচ্ছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এ ধরনের বৈষম্য বিচ্ছিন্নতা এবং অবিশ্বাসের অনুভূতি বাড়িয়ে দিতে পারে, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি অনেকের দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রভাবিত করছে।
এর বাইরেও অভিবাসনসহ নীতিগত নানা পরিবর্তন দেশটিতে মুসলিম অভিবাসীদের প্রবাহকে প্রভাবিত করতে পারে বলে মনে করা হয়। এর ফলে মুসলিম সম্প্রদায়ের সম্প্রসারণ যেমন ব্যাহত হচ্ছে, তেমনি এ ধরনের ‘বিতর্কিত’ নীতি ‘অভিবাসনবান্ধব দেশ’ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের পরিচিতিকেও ম্লান করে দিতে পারে।
এখানে এটিও লক্ষণীয় যে, রাষ্ট্রের বৃহত্তর রাজনৈতিক এবং সামাজিক অবস্থান মুসলমানসহ সংখ্যালঘু গোষ্ঠীগুলো কীভাবে সমাজে তাদের গুরুত্বের জানান দেবে। অর্থাৎ কোনো দেশের সরকার যদি তার দেশের সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ করে, সেটি একসময় সরকারের জন্যই বিপত্তির কারণ হতে পারে, যেমনটি হচ্ছে বাইডেন প্রশাসনের সঙ্গে।
যদিও এমন অনেক কারণ রয়েছে যা একটি দেশের সঙ্গে একজন ব্যক্তির বা একটি সম্প্রদায়ের সম্পর্ককে প্রভাবিত করতে পারে। তবে এটি স্পষ্ট যে, যুক্তরাষ্ট্রে মুসলমানদের অভিজ্ঞতা বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক এবং ব্যক্তিগত কারণ থেকেই আজকের এ পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই সূক্ষ্ম বিষয়গুলোই হলো আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং সম্মানজনক পরিবেশ গড়ে তোলার মূল চাবিকাঠি।
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র কি আদৌ এসব বিষয় বোঝার চেষ্টা করছে? নাকি বুঝেও বুঝতে চাইছে না তারা? এসব প্রশ্নের উত্তর দেয়া কিছুটা জটিল হলেও, পরপর দুটি খবর সবাইকে বেশ ভাবিয়ে তুলেছে। প্রথমত, যুক্তরাষ্ট্রে রেকর্ড হারে মুসলিমবিদ্বেষ বেড়ে যাওয়া এবং দ্বিতীয়ত, সন্ত্রাসী তালিকা থেকে তালেবানকে বাদ দেয়ার পরিকল্পনা মস্কোর। বিপরীতমুখী বিষয় হলেও, ইস্যুটি যে এখানে অভ্যন্তরীণ গণ্ডি ছাড়িয়েছে তা স্পষ্ট।
‘মুসলিমবিদ্বেষের রেকর্ড’
গত বছর থেকে যুক্তরাষ্ট্রে মুসলিমবিদ্বেষী ঘটনা রেকর্ড হারে বেড়েছে। এর পেছনে ছিল মূলত ইসলামভীতি (ইসলামোফোবিয়া) এবং বছরের শেষ দিকে গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসন ঘিরে সৃষ্ট পক্ষপাত।
মঙ্গলবার (২ এপ্রিল) যুক্তরাষ্ট্রে কাজ করা পরামর্শক প্রতিষ্ঠান (অ্যাডভোকেসি গ্রুপ) কাউন্সিল অন আমেরিকান ইসলামিক রিলেশনস (সিএআইআর) এ তথ্য জানিয়েছে।
সিএআইআরের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ইসলামবিদ্বেষ সংক্রান্ত মোট ৮ হাজার ৬১টি ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে, যা ২০২২ সালের তুলনায় ৫৬ শতাংশ বেশি। এমনকি সংগঠনটির ৩০ বছরের ইতিহাসে এ সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এর মধ্যে অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে প্রায় ৩ হাজার ৬০০টি ঘটনা ঘটেছে।বিশ্বের বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনও একই ধরনের ধারণা দিয়েছে। এসব সংগঠন বলছে, গাজায় ইসরাইলের যুদ্ধ ঘিরে ইসলামোফোবিয়া, ফিলিস্তিনবিরোধী জনমত ও ইহুদিবিদ্বেষ বিশ্বজুড়ে ব্যাপক হারে বেড়েছে।
সিএআইআর জানায়, ২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ইসলামবিদ্বেষের ঘটনা কমেছিল। তবে ২০২৩ সালেই তা আবারও বাড়তে থাকে। গত বছরের প্রথম ৯ মাসের প্রতি মাসে গড়ে ৫শ’র মতো এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। তবে শেষের তিন মাসে তা অনেক বেড়ে যায়। এ সময় প্রতি মাসে ১২শটি করে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ইসলামোফোবিয়ার এ বৃদ্ধির কারণ হলো ২০২৩ সালের অক্টোবরে ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাত। ওই বছর অভিবাসন ও আশ্রয়, কর্মসংস্থান বৈষম্য, ঘৃণামূলক অপরাধ ও শিক্ষাবৈষম্য নিয়ে সবচেয়ে বেশি অভিযোগ এসেছে।
‘দাঁতভাঙা জবাব’
যুক্তরাষ্ট্রে নিজেদের শক্তি ও ঐক্য দেখিয়েছেন মুসলিম কমিউনিটির নেতারা। বাইডেন প্রশাসন থেকে দেয়া ইফতারের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেছেন তারা। এর মাধ্যমে গাজায় ইসরাইলের বর্বরতাকে সমর্থন দিয়ে আসা মার্কিন প্রেসিডেন্টের প্রতি নিজেদের ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন মার্কিন মুসলমানরা। বাধ্য হয়ে ইফতার আয়োজন বাতিল করে বাইডেন প্রশাসন।
গত বছরও রমজান ও ঈদে হোয়াইট হাউসে বড় আকারে সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়েছিল। অনেক মুসলমান সেখানে উপস্থিত ছিলেন। সেসময় সবাই বাইডেনের প্রতি নিজেদের ভালোবাসা আর সমর্থনের কথাও জানিয়েছিলেন।
রীতি অনুযায়ী এবারও বাইডেন প্রশাসন থেকে ইফতার আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয় এবং অনেককে আমন্ত্রণ জানানো হয়। তবে যাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল, তারা তা প্রত্যাখ্যান করেন। এর মাধ্যমে মুসলিম কমিউনিটির নেতারা সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে নিজেদের ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
পরে বলা হয়, মুসলিম সম্প্রদায়ের নেতাদের সঙ্গে একটি বৈঠকের আয়োজন করতে চায় বাইডেন প্রশাসন। এতেও সাড়া মেলেনি। এমন পরিস্থিতিতে হোয়াইট হাউস বাধ্য হয় আয়োজন বাতিল করতে।
গাজায় ইসরাইলের বর্বরতার প্রতি বাইডেনের সমর্থনে মার্কিন মুসলমানরা ক্ষুব্ধ। ইসরাইলের প্রতি দৃঢ় সমর্থন দিয়ে মুসলিম সম্প্রদায়ের সঙ্গে যে উত্তেজনা তৈরি হয়েছে, তা কমাতেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ইফতার আয়োজন এবং মুসলিম নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করতে চেয়েছিলেন।
গাজায় ইসরাইল হামলা শুরুর পর থেকে তাতে অন্ধ সমর্থন আর অস্ত্র সহায়তা দিয়ে আসছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। এরপর বাইডেন এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্পর্কে কতটা ফাটল ধরেছে তার নতুন প্রমাণ ইফতারের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান।
এর আগে, গাজায় অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির দাবিতে চলতি বছর হোয়াইট হাউসে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের রমজান ও ঈদ উদযাপন অনুষ্ঠান বর্জনের ঘোষণা দেয় যুক্তরাষ্ট্রের মুসলিম দলগুলো। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ইসরাইলের প্রতি বাইডেনের নগ্ন সমর্থনে ক্ষুব্ধ হয়ে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন দেশটির মুসলমানরা।
ডেমোক্রেটিক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন যখন তিন বছর আগে দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তখন অনেক মুসলমান নেতা ডোনাল্ড ট্রাম্পের ধর্মান্ধতার পাতা উল্টাতে আগ্রহী ছিলেন। কেননা যুক্তরাষ্ট্রে মুসলমানদের প্রবেশ সম্পূর্ণ বন্ধ করতে চেয়েছিলেন ট্রাম্প। তবে এখন ডেমোক্র্যাটরা আশঙ্কা করছেন, বাইডেনের মুসলমানদের মধ্যে সমর্থন কমে যাওয়া তার রিপাবলিকান পূর্বসূরিকে হোয়াইট হাউসে ফিরে যাওয়ার পথ পরিষ্কার করতে সহায়তা করতে পারে।
তালেবানকে সন্ত্রাসী তালিকা থেকে বাদ দেবে রাশিয়া?
যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে যখন মসলমানরা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন, ঠিক তখনই আফগানিস্তানের ক্ষমতাসীন তালেবানকে নিষিদ্ধ সন্ত্রাসী সংগঠনের তালিকা থেকে বাদ দেয়ার ইঙ্গিত দিয়েছে রাশিয়া। দুই বিষয় ভিন্ন ভিন্ন মনে হলেও, এর গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্য রয়েছে বলেই মনে করেন বিশ্লেষকরা।
মঙ্গলবার (২ এপ্রিল) ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ সাংবাদিকদের বলেছেন, আফগানিস্তান এমন একটি দেশ যেটি আমাদের পাশে আছে। তালেবান নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয় আছে। আমরা তাদের সঙ্গে বিভিন্ন উপায়ে যোগাযোগ করি। আমাদের সমস্যাগুলো সমাধান করতে হবে, এজন্য সংলাপ প্রয়োজন।
পেসকভ ‘গুরুত্বপূর্ণ বিষয়’ নিয়ে বিস্তারিত বলেননি। তবে গত মাসে দুই দশকের মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক হামলার শিকার হয়েছে রাশিয়া। মস্কোর একটি কনসার্ট হলে হামলা চালিয়ে কমপক্ষে ১৪৪ জনকে হত্যা করে বন্দুকধারীরা। ইসলামিক স্টেট (আইএস) এই হামলার দায় স্বীকার করেছে।
মার্কিন কর্মকর্তারা বলছেন, তাদের কাছে হামলার বিষয়ে গোয়েন্দা তথ্য ছিল। তবে রাশিয়া বলছে, হামলার ঘটনায় তারা ইউক্রেনের একটি সূত্রের বিষয়ে তদন্ত করছে, যা কিয়েভ এবং যুক্তরাষ্ট্র দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে।
২০২১ সালে আফগানিস্তানের ক্ষমতায় ফিরে আসে তালেবান। সংগঠনটি এখন পর্যন্ত রাশিয়ার ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’-এর তালিকায় রয়েছে।সব মিলিয়ে বলা যায়, চলমান গাজা যুদ্ধ আর আসন্ন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে বেশ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে বিশ্ব রাজনীতির মাঠ। রাজনীতির এই খেলায় কেউ স্বার্থ হাসিলে মরিয়া, আর কেউ ভুক্তভোগী। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, মুসলমান বা অন্য সংখ্যালঘুদের যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে এই মুখ ফিরিয়ে নেয়ার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে না নিলে, খুব অচিরেই তার পরিণতি ভোগ করতে হবে বাইডেন প্রশাসনকে।
আপনার মতামত লিখুন :