বাংলাদেশ শুক্রবার, ১৩ জুন, ২০২৫, ৩০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে তুরস্কের কৌশলগত চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা

দৈনিক প্রথম সংবাদ ডেস্ক

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ৭, ২০২৫, ১২:৪৪ এএম

ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে তুরস্কের কৌশলগত চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান দীর্ঘ দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে অত্যন্ত কৌশলীভাবে পশ্চিমা বিশ্ব, রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছেন। তাঁর এই কৌশলের ফলে একদিকে যেমন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের উভয় পক্ষ তুরস্কের সহায়তা থেকে উপকৃত হয়েছে, তেমনি মধ্যপ্রাচ্য ও আশপাশের অঞ্চলে তুরস্কের সামরিক উপস্থিতি ও প্রভাব উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। সিরিয়া, লিবিয়া, ককেশাস, পূর্ব ভূমধ্যসাগর ও উপসাগরীয় অঞ্চলে তুরস্ক শক্তিশালী সামরিক ক্ষমতা গড়ে তুলেছে। একই সঙ্গে আফ্রিকা, মধ্য এশিয়া ও পশ্চিম বলকানেও তুরস্ক তার ‘সফট পাওয়ার’ বিস্তারের মাধ্যমে কূটনৈতিক অবস্থান সুদৃঢ় করতে পেরেছে।

তবে এখন প্রশ্ন হলো, ডোনাল্ড ট্রাম্প যদি দ্বিতীয়বার মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন, তাহলে এরদোয়ান কি তাঁর এই ভারসাম্যপূর্ণ কৌশল অব্যাহত রাখতে পারবেন? তাঁর বর্তমান নীতি কি আগের মতোই লাভজনক থাকবে?

ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদ ও তুরস্ক-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক

ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে তুরস্ক ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে উত্তেজনা বেশ কয়েকবার চরমে পৌঁছেছিল। বিশেষত, রাশিয়া থেকে উন্নত প্রতিরক্ষাব্যবস্থা এস-৪০০ কেনার পর যুক্তরাষ্ট্র তুরস্ককে এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান প্রকল্প থেকে বাদ দেয় এবং আঙ্কারার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এদিকে, এরদোয়ান অভিযোগ করেন যে যুক্তরাষ্ট্র তাঁর অন্যতম রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী ফেতুল্লাহ গুলেনকে আশ্রয় ও সহায়তা দিচ্ছে।

একসময় ট্রাম্প প্রকাশ্যে হুমকি দেন যে যদি তুরস্ক সিরিয়ায় মার্কিন-সমর্থিত কুর্দি বাহিনীর বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালায়, তাহলে তিনি তুরস্কের অর্থনীতি ধ্বংস করে দেবেন। কারণ, তুরস্ক ওই কুর্দি গোষ্ঠীকে নিষিদ্ধঘোষিত কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টির (পিকেকে) অংশ হিসেবে দেখে, যা দেশটির জন্য সবচেয়ে বড় অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা হুমকি হিসেবে বিবেচিত।

তবে ট্রাম্পের প্রতি এরদোয়ানের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি এখনো রয়েছে। ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে ফিরে আসার সম্ভাবনাকে বিশ্বনেতাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি উচ্ছ্বাসের সঙ্গে স্বাগত জানিয়েছেন এরদোয়ান। অন্যদিকে, ট্রাম্পও এরদোয়ানকে ‘বন্ধু’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন এবং সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদের নৃশংস শাসনের পতনে তুরস্কের ভূমিকার প্রশংসা করেছেন।

বাইডেন প্রশাসনের সঙ্গে ঠান্ডা সম্পর্ক

জো বাইডেনের আমলে তুরস্ক ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক ছিল তুলনামূলকভাবে ঠান্ডা। এরদোয়ানকে কখনো হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি, যা দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কে দুরত্বের ইঙ্গিত দেয়। তবে বর্তমান মার্কিন প্রশাসনও স্বীকার করছে যে তুরস্ক এখন আত্মবিশ্বাসী একটি মাঝারি শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, যার বৈশ্বিক কৌশলগত প্রভাব ক্রমশ বাড়ছে।

ইউক্রেন যুদ্ধের ক্ষেত্রে তুরস্ক পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞায় যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। একই সঙ্গে, দেশটি চীন ও রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন ব্রিকস গোষ্ঠীতে যোগ দেওয়ার আবেদন করেও ব্যর্থ হয়েছে। তারপরও তুরস্ক পশ্চিমা জোটের সঙ্গেই থেকেছে এবং ন্যাটোর সদস্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। পাশাপাশি, দীর্ঘদিন ধরে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যপদের প্রত্যাশী হিসেবেও তুরস্কের কূটনৈতিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।

তুরস্ক-ইসরায়েল সম্পর্ক ও মধ্যপ্রাচ্যে সম্ভাব্য সংঘাত

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান জোরালোভাবে হামাস ও ফিলিস্তিনি প্রতিরোধের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। তিনি ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে ‘গণহত্যাকারী’ বলে অভিহিত করেছেন এবং তাঁকে হিটলারের সঙ্গে তুলনা করেছেন। ফলে ইসরায়েলপন্থী ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে এরদোয়ানের সংঘাতের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। তবে বিষয়টি এতটা সরল নয়।

৭ অক্টোবর ২০২৩-এ হামাসের হাতে ইসরায়েলি বেসামরিক নাগরিকদের হত্যার ঘটনার আগে এরদোয়ান আসলে নেতানিয়াহুকে তুরস্কে আমন্ত্রণ জানানোর পরিকল্পনা করছিলেন, যা দুই দেশের সম্পর্ক উন্নয়নের ইঙ্গিত দিয়েছিল। কিন্তু গাজায় ইসরায়েলি সামরিক অভিযানের কারণে দুই দেশের সম্পর্ক আবার সংকটের মুখে পড়ে।

তুরস্ক ২০২৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ইসরায়েলের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা দিলেও, বাস্তবে সম্পর্ক পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়নি। আজারবাইজান থেকে ইসরায়েলে তেল সরবরাহ এখনো তুরস্কের বন্দর ব্যবহার করেই হয়, যা ইঙ্গিত দেয় যে নতুন নামে হলেও দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য অব্যাহত রয়েছে।

এস-৪০০ বিরোধ ও সম্ভাব্য সমাধান

তুরস্ক ও মার্কিন বিশেষজ্ঞরা রাশিয়ার কাছ থেকে কেনা এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ে বিরোধের সমাধানের সম্ভাবনা দেখছেন। একটি সমঝোতা হতে পারে, যেখানে তুরস্ক এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলো ইঞ্চিরলিক বিমানঘাঁটিতে সংরক্ষণ করতে পারে। এটি যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম বৃহত্তম মধ্যপ্রাচ্য ঘাঁটি, যা ওয়াশিংটনের সামরিক কৌশলে গুরুত্বপূর্ণ। এর বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র তুরস্কের ওপর আরোপিত অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করতে পারে এবং তুরস্ককে এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান সরবরাহ করতে পারে। তবে প্রশ্ন হলো, তুরস্ক এখনো এই প্রস্তাবে আগ্রহী কি না, কারণ দেশটি ইতোমধ্যে নিজস্ব যুদ্ধবিমান উন্নয়নের দিকে মনোযোগ দিয়েছে।

তুরস্কের রাশিয়া ও ইউক্রেন নীতি

আঙ্কারা কৌশলগতভাবে একদিকে যেমন মস্কোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছে, তেমনি ইউক্রেনকেও সামরিক সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। ২০২২ সালে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর রাশিয়ার সঙ্গে তুরস্কের বাণিজ্য প্রায় তিন গুণ বেড়েছে, তবে যুক্তরাষ্ট্রের চাপের মুখে কিছু তুর্কি ব্যাংক রুশ নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করা থেকে বিরত থেকেছে।

মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থিতি ও ট্রাম্পের নীতি

ট্রাম্প তাঁর প্রথম মেয়াদে মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘমেয়াদি সামরিক জড়িত থাকার নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন। সিরিয়ায় মার্কিন বাহিনীর উপস্থিতি কমানোর চেষ্টা করেছিলেন, তবে পুরোপুরি সফল হননি। তাঁর দ্বিতীয় মেয়াদে তিনি তুরস্কের সঙ্গে সিরিয়া নীতিতে নতুন সমঝোতায় আসতে পারেন।

তবে যুক্তরাষ্ট্র-তুরস্ক সম্পর্কের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হতে পারে সিরিয়ায় তুরস্ক ও ইসরায়েলের মধ্যে সম্ভাব্য সংঘাত। ইসরায়েলের রাজনীতিবিদ ও শিক্ষাবিদরা তুরস্ককে ইহুদি রাষ্ট্রের জন্য ক্রমবর্ধমান হুমকি হিসেবে দেখতে শুরু করেছেন। অন্যদিকে, কিছু তুর্কি সামরিক পরিকল্পনাবিদ আশঙ্কা করছেন যে ইসরায়েল গোপনে কুর্দি যোদ্ধাদের মাধ্যমে তুরস্কের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে পারে।

উপসংহার

তুরস্ক ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক আগামী দিনে নতুন মোড় নিতে পারে। তবে এরদোয়ান অত্যন্ত কৌশলী ও বাস্তববাদী নেতা। তাই তিনি নিশ্চিতভাবেই এমন পরিস্থিতি তৈরি হতে দেবেন না, যা তাঁর কৌশলগত অবস্থানকে দুর্বল করে দেবে। ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে তুরস্কের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ ও সুযোগ উভয়ই অপেক্ষা করছে।

Link copied!

সর্বশেষ :