উত্তর আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে শহরের প্রাচীন অংশকে বলে মদিনা। আমরা জানি মদিনা শব্দের একটা অর্থ নগর। এ কারণেই হয়তো এমনটা বলা হয়। মরক্কোর ফেজ শহরেও এমন একটা অংশ আছে। সেই মদিনা–ই দেখতে গিয়েছিলাম। আমরা যখন পৌঁছালাম, তখন প্রায় মাথার ওপরে জ্বলজ্বল করছে সূর্য। ফেজের এই অংশ পৃথিবীর সবচেয়ে পুরোনো শহরগুলোর অন্যতম। ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ।
এই মদিনার ভেতরে কোনো যান্ত্রিক যানবাহন চলে না। হেঁটেই চলাচল করে মানুষ। আর মাল টানার কাজ করে গাধা বা ঘোড়া। পুরোনো শহরের ভেতরের পরিবেশের সঙ্গে বাইরের পরিবেশ সম্পূর্ণ ভিন্ন। দরজা দিয়ে ঢুকতেই মনে হলো মধ্যযুগের কোনো শহরে চলে এসেছি। হাঁটার সময় বারবার মনে হচ্ছিল ৯ হাজার গলির এই শহরে না আবার হারিয়ে যাই। এই গোলকধাঁধায় হারিয়ে গেলেই মনে হয় ফেজ আর ফেজের ইতিহাসকে আরও গভীরভাবে উপলব্ধি করা যাবে।
ফেজের এই অংশটাকে ফেজ আল বালিও বলা হয়ে থাকে। রাস্তার দুই পাশে সারি সারি দোকান। মাঝেমধ্যে বাঁশের বেড়ার ছাদ। ফাঁক দিয়ে রোদের আলো ঢুকে একধরনের আধ্যাত্মিক আবহ তৈরি করেছে। বিভিন্ন মসলার দোকান, কাঠের সামগ্রীর দোকান, সিরামিকের কারুকাজ করা সামগ্রীর দোকান, কী নেই। লোকজনও বেশ আন্তরিক, হাসিমুখে আমাদের দিকনির্দেশনা দিচ্ছিল। কিছু দরকারি আরবি কথা শিখে রেখেছিলাম। ওদের সঙ্গে সেগুলো বলার চেষ্টা করতাম। কিন্তু মুশকিল হলো, আমার কথা বুঝে ওরা যে উত্তর দিত, সেটা বোঝার মতো এলেম আবার আমার ছিল না। তারপর কিছু ইশারায়, কিছু ইংরেজিতে বলে বুঝতাম।
প্রথম উটের মাংস খেলাম
ফেজের পুরোনো শহরের গেট থেকে নানা অলিগলি দিয়ে আমাদের থাকার জায়গায় পৌঁছালাম। এটি রিয়াদ নামে পরিচিত। এটি ঐতিহ্যবাহী মরোক্কান বাড়ি, উঠানে বাগান আছে। রুমে বাক্সপেটরা রেখেই বের হলাম দুপুরের খাবারের খোঁজে। ইচ্ছা উটের মাংস খাব। কাছাকাছি একটা রেস্তোরাঁয় ঢুকে মরক্কোর বিখ্যাত তাজিন (কুসকুস, সবজি, মাংস আর মসলা সহযোগে তৈরি খাবার) আর উটের মাংসের বার্গার দিয়ে পেট ভরলাম। জীবনে প্রথম উটের মাংস খেলাম। ভালোই লাগল।
রেস্তোরাঁ থেকে একটু সামনেই বউ ইনানিয়া মাদ্রাসা। মারিনিদ শাসনামলে ১৩৫৫ সালে তৈরি হয় এই মাদ্রাসা। মাদ্রাসাটি তৈরি করা হয় মারিনিদ ও মরোক্কান স্থাপত্যের সংমিশ্রণে। ভ্রমণকারীদের কাছে মাদ্রাসার মূল আকর্ষণ এর উঠান, কাঠ, প্লাস্টার ও সিরামিকের অসাধারণ কারুকাজ। পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন আয়াত, ইসলামিক জ্যামিতিক নকশার কারুকাজের মধ্যে মধ্যযুগের শৈল্পিক সমৃদ্ধি বোঝা যায়। উঠানে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে মন ভরে দেখলাম সুন্দর আর সূক্ষ্ম সব কাজ, শুধু দেখতেই ইচ্ছা করে। মাদ্রাসার সঙ্গেই মসজিদ। অন্য ধর্মের ভ্রমণকারীরা শুধু উঠান পর্যন্ত ঘুরে দেখতে পারলেও মুসলমানদের জন্য পুরো স্থাপনাটিই উন্মুক্ত। মাদ্রাসার ঠিক উল্টো পাশের বাড়িটিতে (দার আল-মাগানা) খেয়াল করলে দেখা যায়, একটি জলঘড়ি। এ ধরনের জলঘড়ি পৃথিবীতে আর বেশি নেই। দুঃখের বিষয় হলো, ঘড়িটি এখন আর চলে না। এটি কীভাবে কাজ করত, সেটা আর কেউ জানে না।
মদিনার গলি ধরে আবার হাঁটা শুরু করলাম। এত মানুষ, তারপরও সবাই নির্বিঘ্নে যে যার গন্তব্যে যাচ্ছে।
আপনার মতামত লিখুন :