বাংলাদেশ রবিবার, ২৬ জানুয়ারি, ২০২৫, ১৩ মাঘ ১৪৩১

গুড়িয়ে দেয়া হল ভারতে অবস্থিত মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের ঐতিহাসিক মুবারক মঞ্জিল

দৈনিক প্রথম সংবাদ ডেস্ক

প্রকাশিত: জানুয়ারি ৮, ২০২৫, ০২:৪৬ এএম

গুড়িয়ে দেয়া হল ভারতে অবস্থিত মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের ঐতিহাসিক মুবারক মঞ্জিল

পূর্বের অক্ষত মুবারক মঞ্জিল। ছবি: সংগৃহীত

ভারতের আগ্রায় অবস্থিত মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব এর ঐতিহাসিক বাসভবন ‘মুবারক মঞ্জিল’ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে, যা ইতিহাস ও স্থাপত্যপ্রেমীদের জন্য এক চরম ধাক্কা। ১৭ শতকের এই মুঘল স্থাপত্যটি মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। অথচ মাত্র তিন মাস আগেই উত্তরপ্রদেশের প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগ ভবনটিকে ঐতিহ্যবাহী ও সংরক্ষণযোগ্য স্থাপত্য হিসেবে চিহ্নিত করেছিল।

ধ্বংসের ঘটনা ও স্থানীয়দের অভিযোগ

মুবারক মঞ্জিলের ধ্বংসাবশেষ

স্থানীয় সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, লখনৌ থেকে সরকারি কর্মকর্তারা ভবনটি পরিদর্শন করার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই এই ঐতিহাসিক স্থাপত্য ভাঙার কাজ শুরু হয়। স্থানীয়দের অভিযোগ, একটি নির্মাণ ব্যবসায়ী পুলিশ-প্রশাসনের একাংশের সঙ্গে যোগসাজশ করে এই কাজটি করেছে। ভবনের ধ্বংসাবশেষ শতাধিক ট্রাক্টরের মাধ্যমে সরিয়ে ফেলা হয়।

কপিল বাজপেয়ী নামে এক স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, “ভবনটির প্রায় ৭০ শতাংশ ইতোমধ্যেই ধ্বংস করা হয়েছে। আমরা কর্তৃপক্ষকে জানিয়েও কোনো প্রতিকার পাইনি। এখন আমরা হাইকোর্টে জনস্বার্থ মামলা করার কথা ভাবছি।”

ঐতিহাসিক গুরুত্ব

ব্রিটিশ পুরাতত্ত্ববিদ আর্চিবল্ড ক্যাম্পবেল কার্লাইল ১৮৭১ সালের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছিলেন যে, মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব সমুদ্রগড়ের যুদ্ধে জয়লাভের পর এই ভবনটি নির্মাণ করেন। অন্যদিকে ঐতিহাসিক রাজকিশোর রাজের মতে, ভবনটি আসলে দারাশিকোর স্থাপত্য ছিল, যেটিকে জয়লাভের পর আওরঙ্গজেব ‘মুবারক মঞ্জিল’ নাম দেন। 

লাল বেলেপাথরের এই ভবনে মুঘল সম্রাট শাহজাহান, সুজা ও আওরঙ্গজেবের বসবাসের ইতিহাস রয়েছে। ব্রিটিশ শাসনামলে এটি শুল্ক ও লবণ দপ্তর হিসেবে ব্যবহৃত হতো। ১৯০২ সালের পর ভবনটি স্থানীয়দের কাছে পরিচিত হয় ‘তারা নিবাস’ নামে।

স্থাপত্যশৈলীর বিশেষত্ব

‘মুবারক মঞ্জিল’ ব্রিটিশ ও মুঘল স্থাপত্যের অপূর্ব মেলবন্ধনের উদাহরণ ছিল। নিচু তোরণ, মিনার ও অনন্য নকশা ভবনটির বিশেষ আকর্ষণ ছিল। এটি শুধু মুঘল ইতিহাসের অংশ নয়, বরং ভারতের ঐতিহাসিক স্থাপত্যশিল্পের একটি গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন ছিল।

প্রশাসনিক প্রতিক্রিয়া

আগ্রার জেলা প্রশাসক অরবিন্দ মাল্লাপ্পা বাঙ্গারি জানিয়েছেন, “ঘটনাটি আমরা গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করছি। ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ ও রাজস্ব বিভাগকে বিষয়টি খতিয়ে দেখতে বলা হয়েছে। এসডিএম ইতোমধ্যে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন এবং রিপোর্ট জমা দেয়ার প্রক্রিয়া চলছে। আপাতত ভবন এলাকায় কাউকে হস্তক্ষেপ করতে দেয়া হবে না।”

বিশ্বব্যাপী প্রতিক্রিয়া

ঘটনাটি নিয়ে স্কটিশ ইতিহাসবিদ উইলিয়াম ডালরিম্পল তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, “প্রশাসনের সম্পূর্ণ মদতে আগ্রার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ভবনটি ধ্বংস করা হয়েছে। এ ধরনের ঘটনা পর্যটন শিল্পের ক্ষতি করছে।” স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ ও আন্তর্জাতিক ইতিহাসবিদদের প্রতিক্রিয়া থেকে ধারণা করা হচ্ছে, এটি একটি পরিকল্পিত ধ্বংসযজ্ঞের অংশ।

আইনি উদ্যোগ

স্থানীয় বাসিন্দারা ভবন ধ্বংসের ঘটনায় হাইকোর্টে জনস্বার্থ মামলা দায়ের করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তাদের মতে, প্রশাসনের দায়িত্বহীনতা ও পরিকল্পিত চক্রান্তের ফলে এই ঐতিহাসিক ভবনটি ধ্বংস হয়েছে।

পর্যবেক্ষণ ও ভবিষ্যৎ করণীয়

এই ধ্বংসযজ্ঞ শুধু ভারতের নয়, সারা বিশ্বের ইতিহাসপ্রেমীদের জন্য একটি বড় আঘাত। পর্যটনশিল্প ও ঐতিহাসিক স্থাপত্য রক্ষার জন্য প্রশাসনকে আরও সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে। ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা রোধে কঠোর আইন প্রণয়ন প্রয়োজন। মুবারক মঞ্জিলের ধ্বংসের মধ্য দিয়ে ইতিহাসের একটি অধ্যায় হারিয়ে গেল। এই ঘটনা ভারত ও বিশ্ব ঐতিহ্যের জন্য একটি বড় শিক্ষা হয়ে থাকবে।


 

Link copied!

সর্বশেষ :