ক্রমেই জ্বালানি তেলনির্ভর অর্থনীতি থেকে বেরিয়ে আসছে সৌদি আরব। ক্ষমতা নেয়ার পর নতুন অর্থনীতি গড়ে তোলার লক্ষ্যে সৌদি যুবরাজ ও প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ বিন সালমান ‘ভিশন ২০৩০’ নামে যে রূপকল্প গ্রহণ করেন ছয় বছর আগেই তা বড় সফলতা দেখলো।মধ্যপ্রাচ্যের রাজতান্ত্রিক দেশটি এই প্রথমবারের মতো মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) তেল ছাড়া অন্যান্য খাতের অবদানে রেকর্ড গড়েছে। ২০২৩ সালে দেশটির জিডিপির ৫০ শতাংশ এসেছে তেল বহির্ভূত খাত থেকে। তেলের আয়ের ওপর নির্ভরতা কমানোর প্রচেষ্টার বিবেচনায় এটাকে দেশটির জন্য একটি বড় অর্জন বলে দেখা হচ্ছে।
চলতি সপ্তাহে পরিসংখ্যান দফতরের জারি করা তথ্য বিশ্লেষণ করে সৌদি অর্থনীতি ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, তেল বহির্ভূত খাতে বিনিয়োগ, মানুষের ভোগ ব্যয় ও রফতানি বাড়তে থাকায় এসব খাত থেকে সৌদি অর্থনীতির মূল্য দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৭০ হাজার কোটি রিয়াল (৪৫৩ বিলিয়ন ডলার)। যা দেশটির প্রকৃত জিডিপির ৫০ শতাংশ। এর মানে তেল এখন আর সৌদি অর্থনীতির একমাত্র অবলম্বন নয়।গত দুই বছরে প্রকৃত বেসরকারি বিনিয়োগে অভূতপূর্ব কর্মকাণ্ডের কারণে তেল বহির্ভূত জিডিপি এই মাইলফলক স্পর্শ করেছে বলে জানানো হয়েছে। এই সময়ে প্রকৃত বেসরকারি বিনিয়োগ বেড়েছে ৫৭ শতাংশ, যার ফলে ২০২৩ সালে মোট প্রকৃত বেসরকারি বিনিয়োগ ৯৫ হাজার ৯০০ কোটি রিয়ালে (২৫৪ বিলিয়ন ডলার) উন্নীত হয়েছে।
বহু বছর ধরে তেল ভান্ডারের জোরে আন্তর্জাতিক অর্থনীতিতে দাপট দেখিয়ে এসেছে সৌদি আরব। কিন্তু জ্বালানি তেল ক্রমেই ফুরিয়ে আসছে। তাছাড়া কার্বনমুক্ত পৃথিবীর লক্ষ্যে জৈব জ্বালানির ব্যবহারও ক্রমে কমছে। ফলে পড়তির দিকে তেলের দামও। এই অবস্থায় তেল নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য একের পর এক পদক্ষেপ নিয়েছেন সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান।তেলনির্ভর নির্ভরতা থেকে মুক্তির জন্য ‘ভিশন ২০৩০’ গ্রহণ করেন এমবিএস। অর্থনীতিকে বহুমুখী করে তুলতে বিভিন্ন সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক সংস্কার করা হয়েছে। সেই সংস্কার প্রকল্পগুলোই ম্যাজিক দেখাতে শুরু করেছে।
তেলকে টেক্কা দিচ্ছে যে যে খাত
সৌদি অর্থনীতি ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, ২০২১-২২ সালে শিল্প ও বিনোদন খাতে ব্যাপক বৃদ্ধি দেখা গেছে। ১০৬ শতাংশ বৃদ্ধি হয়েছে এই খাতে। খাদ্য ও বাসস্থানের মতো খাতে ৭৭ শতাংশ এবং পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে ২৯ শতাংশ বৃদ্ধি হয়েছে।২০২৩-এ স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও বিনোদনের মতো সামাজিক পরিষেবা খাতে ১০ দশমিক ৮ শতাংশ বৃদ্ধি নথিভুক্ত করা হয়েছে। এরপর রয়েছে পরিবহন ও যোগাযোগ খাত। এই ক্ষেত্রে ৭ দশমিক ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। বাণিজ্য, রেস্তোঁরা ও হোটেল খাতে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে।গত দুই বছরে ‘ঐতিহাসিক বৃদ্ধি’ ঘটেছে পর্যটন খাতে। যার প্রভাব পড়েছে পরিষেবা খাতেও। এই খাতে ৩১৯ শতাংশ বৃদ্ধি হয়েছে। সরকারি বিবৃতি অনুযায়ী, বিশ্বের অন্যতম সেরা পর্যটন এবং বিনোদনের গন্তব্যে পরিণত হয়েছে সৌদি আরব।
তেল অর্থনীতি ফুরিয়ে আসছে
সৌদি আরবের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশ দাহরান। এই দাহরানের সমতল ভূমির নিচে ১৯৩০-এর দশকে আবিষ্কার হয় জ্বালানি তেলের ভান্ডার। যা এককালের বেদুইনদের দেশ সৌদি অর্থনীতিকে আমূল পাল্টে দেয়। রাজতন্ত্র শাসিত গভীর ধর্ম বিশ্বাসের এই দেশটির হাতে তখন চলে আসে ‘কালো সোনা’, যার ছিল দুনিয়াকেই পাল্টে দেয়ার ক্ষমতা। কিন্তু সেই ক্ষমতার কোনো নিশ্চয়তা এখন আর নেই।প্রায় শতবর্ষ পরে সৌদি রাজতন্ত্র এক কঠিন বাস্তবের মুখোমুখি হয়। জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে জ্বালানি তেল থেকে সরে বিকল্প জ্বালানির দিকে যাচ্ছে বিশ্ব। সৌদি আরবের তরুণ প্রজন্ম আরও নতুন নতুন সুযোগের সন্ধান করছে।
এমন অবস্থায় নতুন পরিকল্পনা নিয়ে আসেন যুবরাজ মোহাম্মদ। ভিশন ২০৩০ শীর্ষক সেই পরিকল্পনার মাধ্যমে তিনটি লক্ষ্য অর্জনে জোর দেন তিনি। এক. এমন একটি অর্থনীতি তৈরি করা, যা আর তেলের ওপর নির্ভরশীল নয়। দুই. প্রায় চার কোটি মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত করা। তিন. বিশ্ব মঞ্চে দেশটির অবস্থান অক্ষুণ্ন রাখা।
ভিশন ২০৩০ কি
সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের মস্তিষ্কপ্রসূত বিশাল পরিকল্পনা ভিশন ২০৩০। এখন থেকে ৮ বছর আগে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ম্যাকেঞ্জির সহায়তায় ৩৮ বছর বয়স্ক যুবরাজ এই মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করেন। এর অনেক অংশ রয়েছে, যারা কিছু কিছু আবার ‘গিগাপ্রজেক্ট’, অর্থাৎ বিশাল কর্মযজ্ঞের ব্যাপার রয়েছে এখানে।
এসবের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য অংশ হলো ‘নিওম’। দেশটির উত্তর-পশ্চিম এলাকায় এর আওতায় গড়ে তোলা হচ্ছে একটি অত্যাধুনিক শহর, যার নাম ‘দ্য লাইন’। এই মেগাসিটি তৈরিতে খরচ হচ্ছে এক ট্রিলিয়ন ডলার বা এক লাখ কোটি ডলার।নকশায় দেখা গেছে, এটি হবে মরুর বুকে কাচে তৈরি কাঠামো, যা প্রস্থে ৬৫০ মিটার আর দৈর্ঘ্যে ১০০ মাইল। সৌদি আরব বলছে, এই শহরে গাড়ি চলবে না, জ্বালানি আসবে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে। শহরে বাস করবে ৯০ লাখ মানুষ, যাদের যেকোনো সেবা পেতে মাত্র পাঁচ মিনিট হাঁটতে হবে।
অন্য কথায়, দ্য লাইন হবে সৌদি আরব ভিশন ২০৩০-এর মাধ্যমে, যা কিছু অর্জন করতে চায়, তা—অর্থাৎ তেল-পরবর্তী ভবিষ্যৎ, এমন বাসস্থান নির্মাণ, যেখানে থাকবে অর্থনৈতিক সুযোগ এবং ভবিষ্যৎমুখী শহরের এমন মান নির্ধারণ, যা পুরো দুনিয়া অনুসরণ করবে।ভিশন ২০৩০-এর আওতায় ২০টির বেশি প্রকল্প রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে লোহিত সাগরের তীরে অবকাশযাপন কেন্দ্র স্থাপন এবং কিদিয়া নামে এমন একটি শহর নির্মাণ, যা হবে শিল্পকলা ও বিনোদনের রাজধানী। মোদ্দাকথা, সৌদি আরবকে গড়ে তোলা হবে এমন একটি দেশ হিসেবে, যেখানে সব নাগরিকের কাজ থাকবে।এই বিশাল কর্মযজ্ঞের অর্থায়ন করা হচ্ছে সৌদি আরবের রাষ্ট্রীয় সম্পদ তহবিল থেকে, যেটিকে বলা হয় পাবলিক ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড। এর আওতায় ৭০ হাজার কোটি ডলারের সম্পদ রয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে এই তহবিল থেকে সারা বিশ্বেই অর্থ খরচ করা হচ্ছে। সফটব্যাংকের ভিশন ফান্ডের পেছনে ঢালা হয়েছে চার হাজার ৫০০ কোটি ডলার। এর বাইরে বিনিয়োগ পেয়েছে নিউ ক্যাসল ফুটবল ক্লাব, টেসলার প্রতিদ্বন্দ্বী লুসিড, গলফ ও বিভিন্ন ইক্যুইটি তহবিল।
এই তহবিল পরিচালনা করেন যুবরাজ মোহাম্মদ ও তহবিলের গভর্নর ইয়াসির ওসমান আল-রুমাইয়ান। বিশ্বে বড় বড় ব্র্যান্ডের পেছনে অর্থ ঢেলে এই তহবিল আশা করছে যে এর বিনিময়ে ভালো মুনাফা অর্জন করা যাবে, আর পশ্চিমা বিশ্বের নেতারা বিনিয়োগের বিনিময়ে সৌদি আরবে পাল্টা বিনিয়োগ করবেন।
সৌদি আরব বিশ্বের সবচেয়ে বড় তেল রফতানিকারক দেশ। গত বছর রাষ্ট্রীয় তেল কোম্পানি আরামকো বিস্ময়কর পরিমাণ মুনাফা পেয়েছে ১৬ হাজার ১০০ কোটি ডলার। কিন্তু পুরো বিশ্ব যেহেতু কার্বনহীন জ্বালানির দিকে যাচ্ছে, তাই সৌদির রাজকীয় পরিবার জানে যে তেল বহির্ভূত আয় আগামী দিনে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সে কারণে তারা দেশ ও বিদেশে বিপুল বিনিয়োগ করেছে।
আপনার মতামত লিখুন :