ইউরোপে বসবাসরত মুসলিমরা ক্রমবর্ধমান বৈষম্য ও বর্ণবাদের শিকার হচ্ছেন, যা তাদের জীবনযাত্রাকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিচ্ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) মানবাধিকার সংস্থা এজেন্সি ফর ফান্ডামেন্টাল রাইটস (এফআরএ) সম্প্রতি একটি জরিপে এ বিষয়ে উদ্বেগজনক তথ্য প্রকাশ করেছে। গার্ডিয়ান এবং আনাদোলু এজেন্সি’র প্রতিবেদনে এ জরিপের বিস্তারিত উঠে এসেছে।
বৈষম্যের ক্রমবৃদ্ধির পরিসংখ্যান ও দেশভিত্তিক তথ্য
এফআরএ-এর জরিপ অনুযায়ী, ইইউ সদস্য ১৩টি দেশে বসবাসরত ৯,৬০০ মুসলিমের মধ্যে প্রায় অর্ধেকই দৈনন্দিন জীবনে বৈষম্য ও ঘৃণামূলক বক্তব্যের শিকার হচ্ছেন। এই জরিপটি ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২২ সালের অক্টোবরের মধ্যে পরিচালিত হয়। জরিপে অংশগ্রহণকারীরা জানিয়েছেন যে, ২০১৬ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে মুসলিমদের বিরুদ্ধে বৈষম্য এবং ঘৃণা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে।
বৈষম্যের দিক থেকে সবচেয়ে বিপর্যস্ত দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে অস্ট্রিয়া (৭১%), জার্মানি (৬৮%), এবং ফিনল্যান্ড (৬৩%)। অন্যদিকে, সুইডেন (২২%), স্পেন (৩০%), এবং ইতালি (৩৪%)-এ বৈষম্যের মাত্রা তুলনামূলকভাবে কম।
শিক্ষা, চাকরি ও আবাসনে বৈষম্য
জরিপে অংশ নেওয়া মুসলিমরা জানান, ইউরোপে তাদের সন্তানেরা স্কুলে বুলিংয়ের শিকার হচ্ছে, যা তাদের মানসিক ও শিক্ষাজীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। চাকরি ক্ষেত্রেও মুসলিমরা অসমতার শিকার হচ্ছেন; বিশেষ করে ধর্মীয় পোশাক পরিধানকারী মুসলিম নারীরা বৈষম্যের মুখে পড়ছেন। এই তরুণীদের মধ্যে ৫৮% জানান, স্কার্ফ পরিধানের কারণে তারা বৈষম্যের শিকার হয়েছেন।
এছাড়াও আবাসন ক্ষেত্রে মুসলিমরা বৈষম্যের সম্মুখীন হচ্ছেন। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ৩৫% জানান, ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে বাড়ি কিনতে বা ভাড়া পেতে বাধার সম্মুখীন হয়েছেন।
মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাতের প্রভাব ও বর্ণবাদ বৃদ্ধি
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের ইসরায়েলে আক্রমণের পর ইউরোপে মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষপ্রসূত অপরাধের পরিমাণ আরও বেড়েছে। এর মধ্যে জার্মানির বার্লিনে একটি সিনাগগে অগ্নিসংযোগের চেষ্টা এবং ফ্রান্সে মুসলিম কাউন্সিল এবং মসজিদগুলোর বিরুদ্ধে হুমকিসংবলিত চিঠি পাঠানোর ঘটনা উল্লেখযোগ্য।
বর্ণবাদ ও মুসলিমবিরোধী বিদ্বেষের ফলাফল
বর্ণবাদ ও বৈষম্যের কারণে মুসলিমদের জীবনমান নিম্নমুখী হচ্ছে। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে মুসলিমরা দারিদ্র্যে দিন কাটাচ্ছেন এবং ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় বাস করতে বাধ্য হচ্ছেন। জরিপে দেখা গেছে, অস্থায়ী চুক্তিতে চাকরি করা মুসলিমের সংখ্যা সাধারণ জনগণের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি। এছাড়া, সাধারণ শিক্ষার্থীদের তুলনায় মুসলিম শিক্ষার্থীরা প্রায় তিন গুণ বেশি সংখ্যায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ত্যাগ করছেন।
বর্ণবাদ নিরসনে করনীয় ও সুপারিশ
এফআরএ’র জরিপের সহরচয়িতা ভিডা বেরেসনেভিসিউটে বলেন, “আমরা দেখছি মুসলিমদের অবস্থা ক্রমাগত খারাপ হচ্ছে, ইউরোপে মুসলিম হিসেবে বাস করা আরও কঠিন হয়ে উঠছে।” সংস্থাটির পরিচালক শিরপা রাউতিয়ো বলেন, “ইউরোপে মুসলিমদের বিরুদ্ধে বর্ণবাদ ও বৈষম্য উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে, মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাত সেটাকে আরো উসকে দিয়েছে।”
ইইউকে বৈষম্য প্রতিরোধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে এবং এর বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে আরও বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহের জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে। যুক্তরাজ্য ছাড়া অধিকাংশ ইউরোপীয় দেশ বর্ণ বা জাতিগত বৈচিত্র্য সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহে আদমশুমারি করে না, যা সমস্যার যথাযথ বিশ্লেষণ ও সমাধানে একটি বড় বাধা হিসেবে বিবেচিত।
ইইউ’র ১৩টি দেশে মুসলিমদের এই প্রতিকূল অভিজ্ঞতা এবং বর্ণবাদের স্থায়িত্ব প্রমাণ করে যে, এটি একটি স্থায়ী সমস্যায় রূপ নিয়েছে এবং এ ব্যাপারে পদক্ষেপ গ্রহণ এখনই জরুরি।
আপনার মতামত লিখুন :