নতুন বছরের প্রথম দিন যুক্তরাষ্ট্রের লুইজিয়ানা রাজ্যের নিউ অরলিন্স শহরে বোরবন স্ট্রিটে ভয়াবহ ট্রাক হামলায় ১৫ জন নিহত এবং বহু মানুষ আহত হয়। হামলাকারী টেক্সাসের বাসিন্দা এবং সাবেক মার্কিন সেনাসদস্য শামসুদ্দিন জব্বার (৪২) পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন। তবে এফবিআই জব্বারকে নিয়ে মিডিয়ায় প্রচারিত সন্ত্রাসবাদের তথ্য পুনর্মূল্যায়ন করছে। জানা গেছে, তিনি পারিবারিক ও মানসিক সমস্যায় ভুগছিলেন। তার আইএস-এর সাথে সরাসরি কোনো সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
ঘটনা এবং প্রাথমিক তথ্য
জব্বার একটি ভাড়া করা ট্রাক নিয়ে মানুষের ভিড়ে ঢুকে পড়েন। এসময় ট্রাকে ইসলামিক স্টেট (আইএস)-এর পতাকা উড়ছিল। এফবিআই জানায়, হামলার কয়েক ঘণ্টা আগে জব্বার ফেসবুকে পাঁচটি ভিডিও পোস্ট করেন, যেখানে তিনি আইএসের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। ভিডিওগুলোতে তিনি গান, মদ, এবং মাদকের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
এফবিআইয়ের উপসহকারী পরিচালক ক্রিস্টোফার রায়া জানান, হামলাটি পূর্বপরিকল্পিত ছিল এবং জব্বার নিজেই একাই এটি চালান। তবে সংস্থাটি এখনো নিশ্চিত নয় যে, তিনি সরাসরি আইএস থেকে কোনো নির্দেশনা পেয়েছিলেন কি না।
জব্বারের জীবন এবং মানসিক অবস্থা
শামসুদ্দিন জব্বার মার্কিন সেনাবাহিনীতে ১৩ বছর কাজ করেছেন। তিনি আফগানিস্তানেও কিছুদিন মোতায়েন ছিলেন। তার ভাই আবদুর রহিম জানান, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জব্বার মানসিক এবং পারিবারিক সংকটে ছিলেন। ২০২২ সালে তার বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে, যা তাকে গভীরভাবে নাড়িয়ে দেয়।
জব্বারের ভাই রয়টার্সকে বলেন, “বিবাহবিচ্ছেদের পর থেকে সে অনেক বেশি রেগে যেত এবং পরিবারের সদস্যদের হত্যার হুমকি পর্যন্ত দিয়েছিল।” ২০২৩ সালে তার বাবার স্ট্রোক হওয়া এবং আর্থিক সংকট পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে।
আইএসের সঙ্গে সম্পর্ক এবং এফবিআইয়ের বয়ান
এফবিআইয়ের মতে, জব্বারের ট্রাকে পাওয়া আইএসের পতাকা এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার পোস্ট তাকে সন্ত্রাসবাদী হিসেবে চিহ্নিত করে। তবে, জব্বারের ভাইয়ের বক্তব্য এ বয়ানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। তার ভাই বলেন, “জব্বার স্মার্ট এবং ঠাণ্ডা মেজাজের ছিল। তার এই কাজ করা অসম্ভব।”
জব্বার ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করেছিলেন, কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে নিজের ধর্মে ফিরে আসেন। তার সাউন্ডক্লাউড অ্যাকাউন্টে গানকে ‘শয়তানের কণ্ঠস্বর’ বলে উল্লেখ করা হয় এবং মাদক ও অ্যালকোহলকে তীব্র সমালোচনা করা হয়।
মিডিয়ার ভূমিকা: বস্তুনিষ্ঠতা নাকি পক্ষপাত?
হামলার পর পশ্চিমা গণমাধ্যমে, বিশেষত রয়টার্স এবং এএফপির প্রতিবেদনগুলো জব্বারকে ‘আইএস অনুগত সন্ত্রাসী’ হিসেবে তুলে ধরেছে। অনেক মিডিয়া এফবিআইয়ের প্রাথমিক বিবৃতি থেকে সরাসরি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে।
তবে আল জাজিরার সাংবাদিক সোরায়া সালামের মতে, এই ধরনের ট্র্যাজিক ঘটনার পেছনের জটিলতাগুলো উপেক্ষা করা হলে সঠিক সত্য উদ্ঘাটন অসম্ভব। তিনি উল্লেখ করেন, “পশ্চিমা মিডিয়া শ্বেতাঙ্গ হামলাকারীদের ক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্য এবং ব্যক্তিগত সংকটের ওপর জোর দেয়। অথচ মুসলিম হামলাকারীদের ক্ষেত্রে সরাসরি ‘সন্ত্রাসী’ তকমা দেওয়া হয়।”
রাজনীতি এবং সামাজিক প্রভাব
২০০১ সালের ৯/১১ হামলার পর সাদ্দাম হোসেন ও আল-কায়েদার সম্পর্ক নিয়ে করা মিথ্যা দাবি ইরাকে মার্কিন আগ্রাসনের ন্যায্যতা তৈরি করেছিল। আইএসের জন্মও এই পরিস্থিতি থেকে হয়েছে। নিউ অরলিন্সের হামলা মুসলিমবিরোধী মনোভাব এবং নীতি তৈরিতে একই ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। সোরায়া সালাম আরও উল্লেখ করেন, “নিউ অরলিন্স ও হিউস্টনের মুসলিম সম্প্রদায়, যারা জব্বারকে চেনেন না তারাও এই ঘটনার জন্য দোষারোপের মুখে পড়তে পারেন।”
প্রশ্নবিদ্ধ তদন্ত এবং ভবিষ্যৎ করণীয়
এফবিআই বলেছে, হামলার পেছনে জব্বারের ব্যক্তিগত সংকট এবং মানসিক অবস্থা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তবে, তাদের প্রমাণ এবং উপসংহার নিয়ে প্রশ্ন তোলা দরকার। গণমাধ্যমের উচিত সরকারি বিবৃতির বাইরে গিয়ে হামলাকারীর জীবন এবং প্রেক্ষাপট গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা।
শেষ কথা
নিউ অরলিন্স ট্রাক হামলা শুধুই সন্ত্রাসবাদী একটি ঘটনা নয়। এটি মানসিক স্বাস্থ্য, ব্যক্তিগত সংকট, এবং সামাজিক বিভাজনের জটিল সমীকরণ। পশ্চিমা মিডিয়ার দায়িত্বহীন প্রতিবেদনের ফলে মুসলিম সম্প্রদায় আরও বেশি বিচ্ছিন্ন হওয়ার ঝুঁকিতে পড়তে পারে। এই ধরনের ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ প্রয়োজন, যাতে সত্য উদ্ঘাটন এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা যায়।
(তথ্যসূত্র: রয়টার্স, এফবিআই, আল জাজিরা)
আপনার মতামত লিখুন :