যুক্তরাজ্যে গত দুই বছরে স্বামীর হাতে খুন হয়েছেন চার বাংলাদেশি নারী। তাঁরা হলেন ইয়াসমিন বেগম, আয়শা হাসান, সোমা বেগম ও কুলসুমা আক্তার।
২০২২ সালের মার্চ থেকে চলতি বছরের এপ্রিলের মধ্যে এসব নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটে। পৃথক দুটি হত্যার ঘটনায় এক আসামিকে ৩৩ বছর, আরেকজনকে ২১ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। অপর দুই হত্যা মামলা এখনো বিচারাধীন।
‘পারিবারিক কলহের’ জেরে এমন নৃশংস হত্যার ঘটনাগুলো যুক্তরাজ্যে বসবাসরত বাংলাদেশিদের মধ্যে উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে।
প্রথম ঘটনাটি ঘটে ২০২২ সালের ২৪ মার্চ। পূর্ব লন্ডনের বেথনাল গ্রিন এলাকার গ্লোব রোডের বাসায় স্বামী কাইয়ুম মিয়ার (৪১) হাতে খুন হন তিন সন্তানের মা ইয়াসমিন (৪০)।
ঘটনার বিবরণ থেকে জানা যায়, পারিবারিক দ্বন্দ্বের কারণে আলাদা থাকতেন কাইয়ুম-ইয়াসমিন। তাঁদের বিবাহবিচ্ছেদের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন ছিল। ঘটনার দিন ইয়াসমিন সন্তানদের স্কুলে দিয়ে বাসায় ফেরেন। তিনি দেখেন, তাঁর বাসায় ঢুকে ‘মাদকাসক্ত’ স্বামী কাইয়ুম মূল্যবান জিনিসপত্র চুরির চেষ্টা করছেন। এ সময় ইয়াসমিন তাঁর স্বামীকে বাধা দেন। একপর্যায়ে ইয়াসমিনকে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করেন কাইয়ুম। তিনি নগদ অর্থ, ব্যাংক কার্ড ও অলংকার নিয়ে পালিয়ে যান।
ইয়াসমিন হত্যার ঘটনায় কাইয়ুমকে প্লাসটো থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। স্ত্রী হত্যার দায়ে ২০২৩ সালের ৯ জুন কাইয়ুমকে ৩৩ বছরের কারাদণ্ড দেন যুক্তরাজ্যের আদালত।
২০২২ সালের ১৯ মে পূর্ব লন্ডনের কেনিংটাউনে নিজ ফ্ল্যাটে পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত স্বামী আসিম হাসানের (৩২) হাতে খুন হন দুই সন্তানের জননী ব্রিটিশ-বাংলাদেশি নারী আয়শা হাসান (৩৪)।
ঘটনার বিবরণ থেকে জানা যায়, সেদিন ভোরে কাজ থেকে বাসায় ফেরেন আসিম। স্ত্রী অন্য কারও সঙ্গে কথা বলেন—এ সন্দেহে আয়শাকে নির্যাতন শুরু করেন আসিম। একপর্যায়ে তিনি স্ত্রীর মাথায় ৩৬ বার ছুরিকাঘাত করেন। পরে জরুরি সেবা নম্বরে ফোন করে স্ত্রীকে ছুরিকাঘাতের কথা নিজেই জানান তিনি। পুলিশ এসে আয়শার লাশ উদ্ধার করে। সে সময় আসিম বলেছিলেন, ‘আমি দোষী। আপনারা আমাকে অভিযুক্ত করতে পারেন।’
তবে পরবর্তী সময়ে আদালতে স্ত্রী হত্যার দায় অস্বীকার করেন আসিম। তিনি দাবি করেন, স্ত্রীকে হত্যার উদ্দেশ্যে হামলা করেননি। স্ত্রী হত্যার দায়ে ২০২৩ সালের ৬ জুলাই আসিমকে ২১ বছরের কারাদণ্ড দেন যুক্তরাজ্যের আদালত।
তৃতীয় ঘটনাটি ঘটে ২০২৩ সালের ৩০ এপ্রিল। পূর্ব লন্ডনের ডকল্যান্ডের ফ্ল্যাটে খুন হন সোমা বেগম (২৪)।
অভিযোগ অনুযায়ী, দুই সন্তানের সামনে সোমাকে হত্যা করেন তাঁর স্বামী আমিনান রহমান (৪৫)। হত্যার পর সোমার লাশ বড় স্যুটকেসে ভরে নদীতে ফেলে দেন আমিনান।
একই দিন আমিনান পুলিশের কাছে সোমার নিখোঁজ হওয়ার অভিযোগ জানান। তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ জানতে পারে, সোমাকে হত্যা করে তাঁর লাশ গুম করেছেন আমিনান। হত্যার ১০ দিন পর টেমস নদী থেকে সোমার স্যুটকেসবন্দী লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এই হত্যার ঘটনায় আমিনানের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। বর্তমানে মামলাটি আদালতে বিচারাধীন।
সর্বশেষ ঘটনাটি ৬ এপ্রিলের। ব্রাডফোর্ড শহরের সড়কে প্রকাশ্য দিবালোকে স্ত্রী কুলসুমা আক্তারকে কুপিয়ে ‘হত্যা’ করেন হাবিবুর মাসুম।
২০২২ সালে যুক্তরাজ্যে আসার পর থেকে ওল্ডহামে বসবাস করতেন হাবিবুর-কুলসুমা দম্পতি। তবে পারিবারিক কলহ ও নির্যাতনের ঘটনায় পুলিশ তাঁদের আলাদা করে দিয়েছিল। সন্তানসহ কুলসুমার নিরাপত্তার কথা ভেবে তাঁদের সরকারের সামাজিক সুরক্ষার আওতায় পার্শ্ববর্তী ব্রাডফোর্ড শহরে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল।
অভিযোগ অনুযায়ী, কুলসুমাকে অনুসরণ করে হাবিবুর ব্রাডফোর্ডে যান। ঘটনার দিন ইফতারি কেনার জন্য কুলসুমা বাসা থেকে বাইরে বের হয়েছিলেন। স্থানীয় একটি মুদিদোকানের সামনে শিশুসন্তানের সামনে স্ত্রীকে ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যান হাবিবুর। কুলসুমাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়া হলে সেখানে তাঁর মৃত্যু হয়।
ঘটনার তিন দিন পর হাবিবুরকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এই হত্যার ঘটনায় সহায়তার অভিযোগে তাঁর ভাই মারুফ ও চার আত্মীয়কে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। তাঁরা এখন জামিনে। মামলাটি বিচারাধীন।
যুক্তরাজ্যে বসবাসরত বাংলাদেশিদের মধ্যে পারিবারিক কলহসহ একের পর এক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা নিয়ে কথা হয় লন্ডনের রেডব্রিজের কাউন্সিলর সাঈদা চৌধুরীর সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বেক্সিট ও করোনা–পরবর্তী সময়ে লন্ডনে জীবনযাত্রা বেশ ব্যয়বহুল হয়ে উঠেছে। বর্তমান বাজারমূল্যের সঙ্গে মধ্যম ও নিম্ন আয়ের লোকেরা সমন্বয় করতে পারছেন না। সহিংস ঘটনাগুলোর পেছনে এই আর্থিক সংকটের একটা বড় ভূমিকা রয়েছে। এ ছাড়া মাদক ও জুয়া এখানে পারিবারিক সহিংসতা বেড়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে।
যুক্তরাজ্যের জাতীয় পরিসংখ্যান দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশটিতে ২০২২ সালের এপ্রিল থেকে ২০২৩ সালের মার্চ পর্যন্ত ১৬ বছরের বেশি বয়সী ২১ লাখ নারী-পুরুষ পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে পুলিশ আট লাখের বেশি পারিবারিক সহিংসতার মামলা তদন্ত করছে।
আপনার মতামত লিখুন :