বাংলাদেশ শনিবার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২৪, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

কেন আলুর দাম এত বৃদ্ধি পাচ্ছে! জেনে নিন নেপথ্যের কারন

দৈনিক প্রথম সংবাদ ডেস্ক

প্রকাশিত: নভেম্বর ২২, ২০২৪, ০৩:১৯ পিএম

কেন আলুর দাম এত বৃদ্ধি পাচ্ছে! জেনে নিন নেপথ্যের কারন

আলুর দাম বেড়েই চলছে। ছবি: সংগৃহীত

গত দুই মাস ধরে দেশের বাজারে আলুর অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধি ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়ের জন্যই সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে পুরাতন আলু প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৭০-৭৫ টাকায়, আর নতুন আলুর দাম ১২০-১৩০ টাকা পর্যন্ত উঠেছে। এ অবস্থায় আলুর দাম বৃদ্ধির প্রকৃত কারণ ও এর সমাধানের প্রয়োজনীয়তা ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে।

বর্তমান বাজার পরিস্থিতি

মিরপুর-১৪ নম্বর নেভি গেট বাজারে পুরাতন আলুর কেজি ৭৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এত দামেও ক্রেতারা আলু কিনতে বাধ্য হচ্ছেন কারণ বাঙালির প্রতিদিনের খাবারের তালিকায় আলু অত্যাবশ্যক। পাইকারি বাজার মিরপুর-১১ ও মিরপুর-১৪-এর কচুক্ষেত থেকে জানা গেছে পুরাতন আলু পাইকারি পর্যায়ে ৬৩ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

বিক্রেতাদের দাবি পাইকারি বাজারে দাম বেশি হওয়ায় খুচরা বাজারেও দাম বাড়ছে। অন্যদিকে বাজার ব্যবস্থাপনার ত্রুটির কারণে এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এসএম নাজির হোসেন।

আলুর দাম বৃদ্ধির মূল কারণসমূহ

১. কোল্ডস্টোরেজের আধিপত্য
ক্যাবের অনুসন্ধান অনুযায়ী কোল্ডস্টোরেজ মালিকদের সিন্ডিকেটের কারণে আলুর দাম বৃদ্ধি পায়। কোল্ডস্টোরেজ মালিকরা তাদের নিজস্ব এজেন্টদের মাধ্যমে কৃষকদের দাদন দিয়ে মাঠ থেকে আগেই আলু কিনে নেন। পরবর্তীতে এই আলু বাজারে এনে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে দাম বাড়ানো হয়।

২. মধ্যসত্ত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য
কৃষক থেকে ভোক্তা পর্যন্ত আলুর দাম ৭-৮ স্তর পার হয়ে পৌঁছায়। এই প্রতিটি স্তরে আলুর দাম বৃদ্ধি পায়।

৩. দাদন প্রথার প্রভাব
কৃষকরা চাষাবাদের আগে মহাজনদের কাছ থেকে অগ্রিম টাকা নিয়ে থাকেন। ফলে আলু ওঠানোর সঙ্গে সঙ্গে কৃষকদের সেই দামে আলু বিক্রি করতে হয়। এতে কৃষকরা প্রকৃত বাজারমূল্য থেকে বঞ্চিত হন।

৪. কৃত্রিম সংকট তৈরি
দেশে আলুর উৎপাদন চাহিদার তুলনায় বেশি হলেও কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বাড়ানো হয়।

সরকারি উদ্যোগ ও সমাধানের প্রচেষ্টা

টিসিবি এর মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি শুরু হয়েছে। টিসিবি রাজধানীর ৫০টি স্পটে ৩০ টাকা কেজি দরে আলু বিক্রি শুরু করেছে। ২০ নভেম্বর কারওয়ান বাজারে এ কার্যক্রম উদ্বোধন করেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বসির উদ্দিন। তিনি সিন্ডিকেটের ভূমিকার কথা স্বীকার করে সরবরাহ ও পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা উন্নয়নের তাগিদ দেন।

এছাড়াও দাদন প্রথা রোধে কৃষকদের জন্য সরাসরি কৃষি ঋণের ব্যবস্থা করার দাবি উঠেছে। কৃষক যাতে নিজেই আলু কোল্ডস্টোরেজে রাখতে পারে সে জন্য আর্থিক সহায়তা দেওয়া প্রয়োজন।

উৎপাদন বনাম বিক্রয় মূল্য

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি কেজি আলু উৎপাদনে খরচ হয় ১০.৫১ টাকা। তবে মাঠ পর্যায়ে কৃষকরা এই আলু মহাজনদের কাছে ২০-২১ টাকা দরে বিক্রি করেন। এরপর রাজধানীর বাজারে সেই আলু বিক্রি হচ্ছে ৭০-৭৫ টাকা কেজি দরে। এটি স্পষ্টতই অস্বাভাবিক এবং অগ্রহণযোগ্য।

কৃষকদের অবস্থান

রাজশাহী ও বগুড়ার কৃষকরা জানান, তারা কম দামে আলু বিক্রি করতে বাধ্য হন। কোল্ডস্টোরেজে আলু সংরক্ষণের সামর্থ্য না থাকায় ফসল ওঠার সঙ্গে সঙ্গে মহাজনদের কাছে আলু বিক্রি করতে হয়। বগুড়ার কৃষক মো. আব্দুল হাফিজ বলেন, “ধার-দেনা করে আলু চাষ করি। কিন্তু কোল্ডস্টোরেজে রাখতে পারি না। ফলে কম দামে বিক্রি করতে হয়।”

সমাধানের পথ

১. দাদন প্রথার বিলুপ্তি
কৃষক যেন সরাসরি কোল্ডস্টোরেজে আলু সংরক্ষণ করতে পারে, সেই ব্যবস্থা করতে হবে।
২. কৃষি ঋণ প্রদান
সরাসরি কৃষি ঋণের মাধ্যমে কৃষকদের আর্থিক সহযোগিতা করতে হবে।
৩. বাজার নিয়ন্ত্রণ
কোল্ডস্টোরেজ ও মধ্যসত্ত্বভোগীদের সিন্ডিকেট ভেঙে কৃষক ও ভোক্তার জন্য সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।
৪. মূল্য বেঁধে দেওয়া
আলুর উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বিক্রির জন্য নির্ধারিত মূল্য বেঁধে দেওয়া প্রয়োজন।

উপসংহার

দেশে আলুর উৎপাদন চাহিদার তুলনায় বেশি হলেও বাজার ব্যবস্থাপনার ত্রুটির কারণে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বৃদ্ধি করা হচ্ছে। এই সমস্যা সমাধানে কৃষক ও ভোক্তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার পাশাপাশি বাজার ব্যবস্থার উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

 

Link copied!

সর্বশেষ :