চার বছর বন্ধ থাকার পর পঞ্চগড় চিনিকল পুনরায় চালুর উদ্যোগ নিয়েছে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। পঞ্চগড় জেলার একমাত্র ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ থাকার কারণে দীর্ঘদিন ধরে হাজারো শ্রমিক ও কৃষক কর্মহীন অবস্থায় দিন কাটাচ্ছিলেন। এই শিল্পটির পুনরুজ্জীবন উত্তরাঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করবে।
চিনিকল বন্ধের ইতিহাস
২০০৫-০৬ অর্থবছরে নানা কারণে পঞ্চগড় চিনিকল আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে শুরু করে। ২০২০ সালে এই ক্ষতির পরিমাণ এতটাই বেড়ে যায় যে, সরকার ছয়টি চিনিকলসহ পঞ্চগড় চিনিকলের কার্যক্রম স্থগিত করে। এরপর থেকে পুরো এলাকায় বিরাজ করতে থাকে এক ভুতুরে পরিবেশ। গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রপাতি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকায় অনেক যন্ত্রাংশের কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়।
এদিকে, ২০১৮ সালে ৬ কোটি ৭ লাখ টাকা ব্যয়ে চিনিকলের বর্জ্য পরিশোধনাগার (ইটিপি) নির্মাণ কাজ শুরু হয়। কিন্তু চিনিকল বন্ধ থাকার কারণে এটি ব্যবহার উপযোগী হয়নি। দীর্ঘদিন ধরে এই গুরুত্বপূর্ণ শিল্পটি পুনরায় চালুর দাবি জানিয়ে আসছিলেন চিনিকলের শ্রমিক, আখ চাষি এবং সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা।
চিনিকল চালুর দাবিতে মানববন্ধন
চিনিকল চালুর দাবিতে আন্দোলন
চিনিকল বন্ধ হওয়ার পর থেকে পঞ্চগড়ের স্থানীয় শ্রমিক-কর্মচারী ও কৃষকেরা এটির পুনরায় চালুর জন্য বারবার দাবি জানিয়ে আসছিলেন। সর্বশেষ ৬ অক্টোবর ২০২৪ তারিখে পঞ্চগড়-ঢাকা মহাসড়কের ধাক্কামাড়া এলাকায় একটি ঘণ্টাব্যাপী মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। এতে অংশ নেন শ্রমিক, কৃষক, স্থানীয় জনগণ এবং শিক্ষার্থীরা। বক্তারা অভিযোগ করেন, দুর্নীতি এবং বৈষম্যের কারণে চিনিকল বন্ধ রাখা হয়েছে।
তারা দাবি করেন, চিনিকল চালুর মাধ্যমে আখ চাষিদের উৎসাহ দেওয়া হবে এবং স্থানীয় অর্থনীতি পুনরুজ্জীবিত হবে। যদি তাদের দাবি মেনে নেওয়া না হয়, তবে তারা আরও কঠোর আন্দোলনের ঘোষণা দেন।
চিনিকল চালুর উদ্যোগ
চার বছর বন্ধ থাকার পর, ২০২৪ সালের ১৭ ডিসেম্বর শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। এতে জানানো হয়, পর্যাপ্ত আখ সরবরাহ নিশ্চিতের মাধ্যমে পঞ্চগড়সহ ছয়টি চিনিকল পুনরায় চালুর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। প্রথম পর্যায়ে শ্যামপুর ও সেতাবগঞ্জ চিনিকল, দ্বিতীয় পর্যায়ে পঞ্চগড় ও পাবনা চিনিকল এবং তৃতীয় পর্যায়ে কুষ্টিয়া ও রংপুর চিনিকল চালু করার প্রক্রিয়া শুরু হবে।
পঞ্চগড় চিনিকল কর্তৃপক্ষের মতে, বর্তমানে ৭৯২ একর জমিতে আখ চাষ করা হচ্ছে এবং ৩১টি ইক্ষু ক্রয় কেন্দ্রের মধ্যে ৮টি চালু রয়েছে। মাঠ পর্যায়ে চাষিদের আখ চাষে উদ্বুদ্ধ করার কাজ শুরু হয়েছে।
স্থানীয়দের প্রতিক্রিয়া ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
প্রজ্ঞাপন প্রকাশিত হওয়ার পর স্থানীয় কৃষক ও শ্রমিকদের মধ্যে নতুন উদ্যম দেখা দিয়েছে। ঠাকুরগাঁও চিনিকলের তত্ত্বাবধানে পঞ্চগড়ে আখ চাষ পরিচালিত হচ্ছে। চলমান আখ মাড়াই মৌসুমে মাঠে ২০০ একর জমিতে আখ চাষ করা হয়েছে।
গত ১৬ নভেম্বর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান পঞ্চগড় চিনিকল পরিদর্শন করেন। তিনি বলেন, “বন্ধ থাকা কলকারখানা পুনরায় চালু করার মাধ্যমে শ্রমিক ও কৃষকদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হবে। পাশাপাশি দখল হওয়া চিনিকলের জমি উদ্ধারের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।”
উৎপাদনের সম্ভাবনা
একসময় পঞ্চগড়ে বছরে প্রায় ৫০-৬০ হাজার মেট্রিক টন আখ উৎপাদিত হতো। বর্তমানে এই পরিমাণ কমে দাঁড়িয়েছে ১৫-২০ হাজার মেট্রিক টনে। চিনিকল পুনরায় চালু হলে আখ চাষে যেমন আগ্রহ বেড়ে যাবে তেমনি উৎপাদন আবারও বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
শেষ কথা
পঞ্চগড় চিনিকল পুনরায় চালুর এই উদ্যোগ শুধু স্থানীয় অর্থনীতির জন্য নয়, বরং দেশের ভারী শিল্প খাত পুনরুদ্ধারের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। তবে, দীর্ঘমেয়াদি সাফল্য নিশ্চিত করতে আখ চাষিদের পর্যাপ্ত প্রণোদনা দেওয়া, চিনিকল আধুনিকায়ন, এবং দুর্নীতি বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে চিনিকলটিকে লাভজনক করতে সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা এখন সময়ের দাবি। পঞ্চগড় চিনিকল চালুর মাধ্যমে আখ চাষি ও শ্রমিকদের জীবনে যে আশার আলো জ্বলতে শুরু করেছে, তা যেন দীর্ঘস্থায়ী হয়।
আপনার মতামত লিখুন :