এ বছরের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের জন্য বই সরবরাহে এক অস্বস্তিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। শিক্ষা বর্ষ শুরু হওয়ার এক মাস পরও প্রায় ২২ কোটি বই এখনও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিতরণ হয়নি, যার ফলে শিক্ষা কার্যক্রমে সমস্যা দেখা দিয়েছে। নতুন বই না পাওয়ায় বিভিন্ন বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পুরোনো বই দিয়ে ক্লাস করছে, ফলে পড়াশোনা ও পাঠ্যক্রম চালাতে তাদের জন্য একাধিক সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে।
প্রাথমিক স্তরে মোট ৯ কোটি ১৯ লাখ বই ছাপানো হয়েছে, তবে এর মধ্যে ৭ কোটি ৩ লাখ বই ছাড়পত্র হয়েছে এবং বাকি সোয়া ২ কোটি বই এখনও সরবরাহ হয়নি। অন্যদিকে, মাধ্যমিক স্তরে প্রায় ৩০ কোটি ৯৬ লাখ বই ছাপানো হয়েছে, এর মধ্যে ১১ কোটি ১৭ লাখ বই ছাড়পত্র হয়ে বিতরণ করা হয়েছে, কিন্তু ১৯ কোটি বই এখনও সরবরাহ হয়নি। সবচেয়ে বড় সংকট হচ্ছে নবম শ্রেণির বই, যেগুলো এখন পর্যন্ত কোনো বিদ্যালয়ে পৌঁছায়নি। এর ফলে নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা বই না পাওয়ায় তাদের পড়াশোনায় ব্যাপক বাধা সৃষ্টি হচ্ছে।
এছাড়াও, বই ছাপানোর কাজ শেষ না হওয়ায়, বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীরা নিয়মিত ক্লাস করতে পারছে না। খাগড়াছড়ির একটি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জানান, তাদের কাছে ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থীরা সব বই পেয়েছে, কিন্তু সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা কেবল তিনটি বই পেয়েছে, এবং নবম শ্রেণির কোনো বই তাদের হাতে পৌঁছায়নি। এই পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীরা পিডিএফ (অনলাইন ভার্সন) ব্যবহার করে ক্লাস চালাচ্ছে, তবে এটি একটি অস্থায়ী সমাধান এবং দীর্ঘ মেয়াদীভাবে এটি কার্যকর হবে না।
একইভাবে, রাজধানী ঢাকা ও পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সরাইল ও অন্যান্য অঞ্চলের বিদ্যালয়গুলোর অবস্থা প্রায় একইরকম। ইস্কাটন গার্ডেন উচ্চবিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা জানিয়েছে, তারা এখন পর্যন্ত চারটি বিষয়ের বই পেয়েছে—বাংলা, ইংরেজি, গণিত ও বিজ্ঞান। তবে তারা বলছে, বাকিগুলো পুরোনো বই দিয়ে পড়াশোনা করছে। তাদের মতে, বইয়ের অভাবে ক্লাসে মনোযোগ দেওয়া খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে।
এই পরিস্থিতিতে স্কুলের শিক্ষকরা জানান, বই না পাওয়ায় তাদেরও বেশ কিছু সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। মতিঝিল সরকারি বালক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক বলেন, "পঞ্চম শ্রেণির পরে বেশিরভাগ বই এখনও বিতরণ হয়নি। শুধুমাত্র কিছু বিষয়ের বই পাওয়া গেছে, এবং শিক্ষার্থীরা পুরোনো বই থেকে পড়াশোনা করছে।"
সরকারি সূত্র জানায়, এবছর প্রায় ৪০ কোটি ১৫ লাখ বই ছাপানোর পরিকল্পনা ছিল, যার মধ্যে ২২ কোটি বই এখনো বিতরণ হয়নি। বই ছাপানোর কাজ সঠিক সময়ে শেষ না হওয়ায়, বিদ্যালয়গুলোতে ক্লাসের কার্যক্রমে বিঘ্ন ঘটছে। বিশেষত নবম শ্রেণির বইয়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ত্রুটি দেখা দিয়েছে। এ পরিস্থিতি দেখে শিক্ষার্থীরা হতাশ। নবম শ্রেণির ছাত্ররা বলছেন, "বই না থাকায় আমরা ঠিকঠাক ক্লাস করতে পারছি না। স্যাররা মৌলিক বিষয়গুলোই শিখাচ্ছেন, কিন্তু নিয়মিত পাঠ্যবই থেকে পড়াশোনা করা সম্ভব হচ্ছে না।"
এছাড়া, বই বিতরণে দেরির একাধিক কারণ রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে নতুন শিক্ষাক্রমের পরিবর্তন, বইয়ের পরিমার্জন, অনুমোদন ও চুক্তির কাজ যথাসময়ে না হওয়া, কাগজ ও আর্ট কার্ডের সংকট এবং সরকারি দরপত্রের বিলম্ব। এসব কারণে বই ছাপানোর কাজ অনেক দেরিতে শুরু হয়েছে এবং এখনো শেষ হয়নি। এতে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা করার সুযোগ সীমিত হয়ে পড়েছে। পাশাপাশি, অধিকাংশ স্কুলে শিক্ষক সংকটও রয়েছে, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে।
এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে এম রিয়াজুল হাসান জানিয়েছেন, তারা চেষ্টা করছেন ১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে সব বই সরবরাহ করতে। তবে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, বই সরবরাহের কাজ শেষ হতে মার্চ মাস পর্যন্তও সময় লাগতে পারে। এর মানে হলো, পুরো শিক্ষাবর্ষে বই না পাওয়া শিক্ষার্থীদের জন্য পড়াশোনায় বাধা সৃষ্টি হবে।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) সূত্রমতে, নতুন শিক্ষাবর্ষে চার কোটির মতো শিক্ষার্থীর জন্য প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের প্রায় ৪০ কোটি ১৫ লাখ বই ছাপানো হচ্ছে। এর মধ্যে প্রায় ২২ কোটি বই এখনো সরবরাহ হয়নি। মাধ্যমিকে (মাদ্রাসার ইবতেদায়িসহ) বইয়ের সংখ্যা ৩০ কোটি ৯৬ লাখের মতো। এর মধ্যে ১ জানুয়ারি পর্যন্ত মাধ্যমিকের ১১ কোটি ১৭ লাখ ৮১ হাজার ২৪২টি পাঠ্যবই ছাড়পত্র বা সরবরাহ হয়েছে। তবে সরবরাহসহ ছাপা হয়েছে ১৪ কোটি ১৭ লাখ ৯৭ হাজার ৬৭৫টি। এর মানে হলো ১৯ কোটি ৭৮ লাখের মতো বই এখনো সরবরাহ হয়নি। আর ছাপার হিসাব করলে প্রায় পৌনে ১৭ কোটি বই ছাপা বাকি।
তবে, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের কর্মকর্তারা আশাবাদী যে, ৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির বই বিতরণ করা সম্ভব হবে এবং নবম শ্রেণির বই ১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে সরবরাহ করা যাবে। এর পরে ১০ম শ্রেণির বই সরবরাহের কাজ শেষ হবে।
অন্যদিকে সরাইল উপজেলায় মাধ্যমিক পর্যায়ে ১৪ হাজার ৮১৬ শিক্ষার্থীর জন্য বইয়ের চাহিদা ৩ লাখ ২০ হাজার ৮৪০টি। এর মধ্যে পাওয়া গেছে ১ লাখ ৭ হাজার ৯৯০টি।
উপজেলা সদরে অবস্থিত সরাইল অন্নদা সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে গতকাল দুপুরে গিয়ে দেখা গেছে, শিক্ষার্থীরা খেলাধুলা করছে। প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বে থাকা জ্যেষ্ঠ শিক্ষক দেবব্রত দাস প্রথম আলোকে বলেন, একদিকে শিক্ষকসংকট, অন্যদিকে রয়েছে বইয়ের ঘাটতি। বইয়ের ঘাটতির কারণে শিক্ষার্থীরা মনোযোগী হচ্ছে না।
কয়রা উপজেলা সদরের সুন্দরবন মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম শ্রেণির তিনটি করে বই পাওয়া গেছে। বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক জানান, নবম শ্রেণির জন্য কোনো বই হাতে পাননি। নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী নাবিলা খানম বলে, ‘বই না থাকায় ঠিকঠাক ক্লাস হচ্ছে না। স্যাররা বইয়ের পড়াশোনার বাইরে মৌলিক বিষয়গুলো শেখাচ্ছেন। জানি না কবে বই পাব।
আপনার মতামত লিখুন :