জেলা বাস মালিক সমিতির সভাপতি বলেন, “বৈঠকে বলেছি, সড়কে চাঁদাবাজী না হলে ও পুলিশ সহযোগিতা করলে পরিবহন শ্রমিকেরাও অনিয়ম করবে না।”
ঈদযাত্রায় দেশের ব্যস্ততম ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লা থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত ২৩১ কিলোমিটার সড়কে যানজটপ্রবণ ২৬টি স্থান চিহ্নিত করেছে হাইওয়ে পুলিশ।
এর মধ্যে অধিক গুরুত্বপূর্ণ ১২টি এবং ১৪টি স্থান কম গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব স্থানের জন্য নেওয়া হয়েছে বাড়তি সতর্কতা।
হাইওয়ে পুলিশ কুমিল্লা অঞ্চলের কর্মকর্তারা জানান, এবারের ঈদ ঘিরে এই মহাসড়কের কুমিল্লা অংশ থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত অধিক গুরুত্বপূর্ণ ১২টি স্থানের মধ্যে আছে- দাউদকান্দির বলদাখাল বাসস্ট্যান্ড, গৌরীপুর বাসস্ট্যান্ড, চান্দিনা বাসস্ট্যান্ড, নিমসার বাজার ও ইউটার্ন, ক্যান্টনমেন্ট মোড় (উভয়মুখী), আলেখারচর বিশ্বরোড়, বিসিক মোড়, চৌদ্দগ্রাম বাজার, লালপোল, ভাটিয়ারী পয়েন্ট, ফৌজদারহাট ইউর্টান, সীতাকুণ্ড বাসস্ট্যান্ড/বড় দারোগারহাট স্কেল।
আর কম গুরুত্বপূর্ণ ১৪টি স্থানের মধ্যে আছে শহীদনগর বাসস্ট্যান্ড, আমিরাবাদ বাসস্ট্যান্ড, ইলিয়টগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড, মাধাইয়া বাসস্ট্যান্ড, কোর্টবাড়ি ইউটার্ন, জাগুরঝুলি কাটা, নুরজাহান হোটেলের সামনের কাটা, সদর দক্ষিণ থানার সামনের কাটা, সুয়াগাজী বাজার (উভয়মুখী), নাজিরা বাজার ইউটার্ন, বারবকুন্ড বাজার, ছোট কুমিরা, কেডিএস মোড়, ফুটলিং এলাকা।
এসব স্থানে বেশি নজরে রাখার কথা জানিয়েছে হাইওয়ে পুলিশ।
যেসব কারণে যানজটের শঙ্কা
যেসব কারণে ওইসব পয়েন্টে ঈদযাত্রায় যানজটের আশঙ্কা রয়েছে- সেগুলোও এরই মধ্যে চিহ্নিত করা হয়েছে।
এরমধ্যে মহাসড়কের পাশে অবৈধ হাটবাজার ও স্থাপনা নির্মাণ, মহাসড়কে যত্রতত্র গাড়ি থামিয়ে যাত্রী উঠানামা, অবৈধ পার্কিং, ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার না করা, উল্টোপথে গাড়ি চালানো, ত্রুটিপূর্ণ সড়কের কারণে, পণ্যবাহী গাড়িতে ওভারলোডের কারণে ধীরগতি, পথচারীদের অসচেতনতা, টোলপ্লাজায় ধীরগতিতে টোল আদায়, দুর্ঘটনার কারণে যানচলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়া, ত্রুটিপূর্ণ/ফিটনেসবিহীন গাড়ি মহাসড়কে বিকল হয়ে যাওয়া, সড়ক পরিবহন আইন অমান্য করে গাড়ি চালানো, মহাসড়কে নিষিদ্ধ ঘোষিত গাড়ি চালানো।
যদিও শুক্রবার ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লা অংশে তেমন কোনো যানজট ছিল না। তবে চট্টগ্রামমুখী লেনে যানবাহনের কিছুটা ধীরগতি লক্ষ্য করা যায়। এছাড়া দাউদকান্দি টোলপ্লাজা এলাকায় কিছুটা জট রয়েছে।
তবে ঈদযাত্রা পুরোপুরি শুরু হলে গুরুত্বপূর্ণ এ মহাসড়কে থাকবে বাড়তি চাপ।
হাইওয়ে পুলিশের দাবি- গত কয়েক বছর ধরেই ঈদের আগে চালক ও যাত্রীরা মহাসড়কটি নিয়ে এমন শঙ্কা প্রকাশ করলেও শেষ পর্যন্ত ঈদযাত্রা হয়েছে স্বস্তির। এবারও তার ব্যতিক্রম হবে না বলে আশা তাদের।
মহাসড়কের কুমিল্লার অংশ ও কুমিল্লা-সিলেট, কুমিল্লা-নোয়াখালী ও কুমিল্লা-চাঁদপুর আঞ্চলিক মহাসড়কের মধ্যে দায়িত্ব পালন করছেন জেলা প্রশাসনের ৩৪ জন নির্বাহী হাকিম।
এছাড়া সওজের পক্ষ থেকেও নেওয়া হয়েছে বিভিন্ন উদ্যোগ।
এসব কারণে হাইওয়ে পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন- ব্যাপক প্রস্তুতির ফলে এবং সবাই একযোগে কাজ করায় সব শঙ্কা কাটিয়ে শেষ পর্যন্ত ঈদযাত্রা স্বস্তিদায়কই হবে।
কারণ অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় এবারের ঈদযাত্রাকে স্বস্তিদায়ক করতে নেওয়া হয়েছে কয়েক স্তরের ব্যবস্থা।
যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবেলায় নিয়োজিত থাকবে হাইওয়ে ও জেলা পুলিশের অতিরিক্ত সদস্য।
এছাড়া হাইওয়ে পুলিশের পাশাপাশি মাঠে রয়েছেন জেলা পুলিশ ও জেলা-উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা।
কুমিল্লা হাইওয়ে পুলিশের উদ্যোগ
কুমিল্লা অঞ্চল হাইওয়ে পুলিশের দেওয়া তথ্য থেকে জানা যায়, ২৩১ কিলোমিটারের ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ককে ভোগান্তিমুক্ত রাখতে হাইওয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে নেওয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ।
ঈদযাত্রা নির্বিঘ্ন করতে তাদের সেক্টর থাকবে দুটি ও সাব সেক্টর ২১টি বিশেষ টিম, মোবাইল ডিউটি থাকবে ৩৪টি, পিকেট ডিউটি ১৫টি, কুইক রেসপন্স টিম মোটরসাইকেলযোগে থাকবে ১৫টি, পিকআপ যোগে ১৫টি, স্ট্রাইকিং রিজার্ভ একটি, রেকার ডিউটি সরকারি পাঁচটি ও বেসরকারি ছয়টিসহ সর্বমোট ১১টি, অ্যাম্বুলেন্স ডিউটি দুটি, কন্ট্রোলরুম একটি, অস্থায়ী কন্ট্রোলরুম বা ওয়াচ টাওয়ার থাকবে ৩৫টি।
এসব সামলাতে ৬৮০ জন পুলিশ ও ৩৫০ জন কমিউনিটি পুলিশিং সদস্য সার্বক্ষণিক মহাসড়ক ও আঞ্চলিক মহাসড়কে নিয়োজিত থাকবেন।
একইসাথে জেলা পুলিশ মহাসড়কের পাশের থানা এলাকায় কাজ করবে, যেখানে সড়কে নির্বিঘ্নে চলাচলের জন্য সড়ক ও জনপদের স্বেচ্ছাসেবী কর্মীরা কাজ করছেন।
যানজটমুক্ত, দুর্ঘটনা প্রতিরোধে অতিরিক্ত ব্যবস্থার পাশাপাশি মহাসড়কে ডাকাতি ও ছিনতাই রোধে নেওয়া হয়েছে বিশেষ সতর্কতা ব্যবস্থা।
কুমিল্লা অঞ্চলের হাইওয়ে পুলিশ জানায়, রোজা ও ঈদযাত্রায় মহাসড়কে দুর্ঘটনা ঘটলে দ্রুত যান চলাচল স্বাভাবিক করতে অ্যাম্বুলেন্সের পাশাপাশি প্রস্তুত রয়েছে বিশেষ কুইক রেসপন্স টিম। সড়কজুড়ে পোশাকধারী পুলিশের পাশাপাশি কাজ করছে কমিউনিটি পুলিশ। বড় কোনো দুর্ঘটনা না ঘটলে এবারের ঈদ যাত্রা নির্বিঘ্নে হবে। এছাড়া যানজট ও দুর্ঘটনার ঝুঁকি এড়াতে প্রতিযোগিতাহীন গাড়ি চালানোর পাশাপাশি সড়ক পারাপারে পথচারীদের সচেতন থাকার পরামর্শ হাইওয়ে পুলিশের।
যাত্রী, চালক ও পরিবহন নেতারা কী বলছেন
এই মহাসড়ক দিয়েই কুমিল্লা থেকে ঢাকায় নিয়মিত যাতায়াত করেন বাসযাত্রী পারভীন আক্তার।
তিনি বলেন, “দাউদকান্দির টোলপ্লাজা, গৌরিপুর, চান্দিনা- এসব এলাকায় বেশি সমস্যা হয়। এসব এলাকায় বাড়তি গুরুত্ব দিতে হবে হাইওয়ে পুলিশকে।”
ওই পথে চলাচল করা বিভিন্ন পরিবহনের চালকদের দাবি, মহাসড়ক ঘেঁষে বিভিন্ন স্থানে বাজার, সড়কে যানবাহনের চাপ, যত্রতত্র যাত্রী ওঠানামা ও গাড়ি পার্কিং, তিন চাকার যানবাহনসহ বেশ কিছু কারণে যানজটের সৃষ্টি হতে।
কুমিল্লা-ঢাকা রুটে চলাচলকারী একটি পরিবহনের বাসচালক নূরে আলম বলেন, “একবার যানজট লেগে গেলে সেটা সহজে শেষ হয় না। এতে যাত্রীদের চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয়।”
হাইওয়ে পুলিশ বাজারগুলোতে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করলে এবং তিন চাকার যান বন্ধ রাখতে পারলে যানজটের সৃষ্টি হবে না বলে দাবি তার।
কুমিল্লা জেলা বাস মালিক সমিতির সভাপতি তাজুল ইসলাম বলেন, “হাইওয়ে পুলিশ ও সড়ক বিভাগ আমাদের সঙ্গে কয়েকদিন আগে বসেছে। তারা আমাদের বলেছে, যেন ঈদ মৌসুমে কোনো ফিটনেসবিহীন গাড়ি না বের করি, গাড়ি স্ট্যান্ড ছাড়া যেন না দাঁড়ায়, যত্রতত্র যাত্রী ওঠানামা না করাসহ বিভিন্ন নির্দেশনা দিয়েছে। আমরা বলেছি, সড়কে চাঁদাবাজী না হলে এবং পুলিশ সহযোগিতা করলে বাস শ্রমিকেরাও অনিয়ম করবে না। অনিয়ম করলে তাদের বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নেব।
হাইওয়ে কমিউনিটি পুলিশিং কুমিল্লা রিজিয়নের সাধারণ সম্পাদক কাজী শারমিন আউয়াল পারভেজ বাপ্পি বলেন, “যেসব স্থান যানজটপ্রবণ সেসব স্থানে আমাদের বিশেষ নজর থাকবে। যদি মালিক, শ্রমিক, হাইওয়ে পুলিশ ও যাত্রীরা সমন্বয় করে এবারের ঈদ যাত্রা পূর্বের তুলনায় আরও বেশি সুন্দর ও নিরাপদ হবে বলে আমি মনে করি।”
সড়ক ও জনপথ বিভাগ-সওজ কুমিল্লার নির্বাহী প্রকৌশলী সুনীতি চাকমা বলেন, “আমরা হাইওয়ে পুলিশ ও পরিবহন নেতাদের সঙ্গে এরই মধ্যে বসে ঈদযাত্রা নিয়ে প্রস্তুতি শেষ করেছি। মানুষের ঈদযাত্রা স্বস্তিদায়ক করতে আমরা উন্নয়ন বা সংস্কার কাজ করছি না এখন। চান্দিনা ও গৌরীপুরে আমাদের নিজস্ব সিসিটিভি ক্যামেরা আছে। সেগুলোর মাধ্যমে মনিটরিং করা হচ্ছে। কোথাও সড়কে কোনো সমস্যার সৃষ্টি হলে তা সমাধানে আমাদের দুটি টিম প্রস্তুত রয়েছে। এছাড়াও আমরা আমাদের স্বেচ্ছাসেবীদেরও মাঠে রেখেছি। তারা পুলিশের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করছে।”
কুমিল্লা জেলা প্রশাসক খন্দকার মু. মুশফিকুর রহমান বলেন, “ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়কসহ কুমিল্লা-নোয়াখালী, কুমিল্লা-সিলেট, কুমিল্লা-চাঁদপুর আঞ্চলিক মহাসড়কে পুলিশ, হাইওয়ে পুলিশ ও জেলা প্রশাসন সমন্বিতভাবে কাজ করছে। এরই মধ্যে মহাসড়ক ও আঞ্চলিক মহাসড়কগুলোতে আমাদের ৩৪ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মাঠে নেমেছেন।
“তাদের নেতৃত্বে অতিরিক্ত ভাড়া, উল্টো পথে আসা গাড়ি, অবৈধ পার্কিং নিরসনে কাজ করবে মোবাইল কোর্ট।
আমরা ঢাকা-চট্রগ্রাম মহাসড়কের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করেছি। মোবাইল কোর্ট, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এবং কমিউনিটি পুলিশের সদস্যরা মহাসড়কে কাজ শুরু করছেন।”
কুমিল্লা জেলা পুলিশ সুপার মো. আব্দুল মান্নান বলেন, “শুধু যানজট নয়, যাত্রী ও চালকদের নিরাপত্তায় সচেষ্ট আছে পুলিশ। ছিনতাই বা ডাকাতির ঘটনা যেন না ঘটে তার জন্য পুলিশের মোবাইল টিম টহলে আছে।”
এছাড়া সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে পুরো মহাসড়ক পর্যবেক্ষণ হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
পুলিশ সুপার আরও বলেন, “এরই মধ্যে মহাসড়ক ও আঞ্চলিক মহাসড়কগুলোতে ২ স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় পুলিশ সদস্যদের নিয়োজিত করা হয়েছে। হাইওয়ে পুলিশের পাশাপাশি মহাসড়কে জেলা পুলিশের ১৪টি পয়েন্টে টিম আছে।”
এছাড়াও কুমিল্লা-নোয়াখালী, কুমিল্লা-সিলেট, কুমিল্লা-চাঁদপুর সড়কেও আমাদের টিম আছে।
মহাসড়কে রাতের বেলা যাত্রীদের চলাচলের কথা মাথায় রেখে জেলা পুলিশের ১৪টি মোবাইল টিম কাজ করবে। এছাড়া হাইওয়ে পুলিশের টিমসহ মোটরসাইকেল পেট্রোল টিম থাকবে।”
হাইওয়ে পুলিশের কুমিল্লা অঞ্চলের পুলিশ সুপারের পদে থাকা অ্যাডিশনাল ডিআইজি মো. খাইরুল আলম বলেন বলেন, “মহাসড়কে কোথাও হাইওয়ে পুলিশ চাঁদাবাজি করলে তা প্রমাণিত হলে তাকে ক্লোজ করা হবে। সুনির্দিষ্ট কারণ ছাড়া কোনোপ্রকার যানবাহন দাঁড় করে হয়রানি করা যাবে না।
“মহাসড়কের যেসব এলাকায় বাজার ও বাসস্ট্যান্ড রয়েছে- সেখানে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। নিষিদ্ধ তিনচাকার গাড়ি আটক হলে আইন অনুসারে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। কুমিল্লা অংশে দাউকান্দিসহ একাধিক স্থানে সিসি ক্যামারার মাধ্যমে সড়কের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।”
দুর্ঘটনাজনিত কারণে কিংবা টোলপ্লাজায় যদি যানবাহনের জটলা তৈরি হয়, সেজন্য হাইওয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে নানা ব্যবস্থা রাখা হয়েছে বলেও দাবি তার।
আপনার মতামত লিখুন :