চট্টগ্রামের কর্ণফুলিতে এস আলম চিনিকলে আগুন লাগার পর গুদামের অপরিশোধিত চিনির গলিত পানি সরাসরি কর্ণফুলী নদীতে গিয়ে পড়ছে। নদীর বিশাল এলাকাজুড়ে পোড়া তেল ও ফেনার মতো ভাসছে চিনির বর্জ্য। এতে নদীর পানি দূষিত হচ্ছে। ছোট জলজ প্রাণীর জন্য এটা হুমকি বয়ে আনতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।এদিকে ৪১ ঘণ্টাতেও আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসেনি। সিলের ভেতরে আগুন জ্বলছে পুরোদমে। ধোঁয়া ছড়াচ্ছে আশপাশে। অপরিশোধিত চিনির ধোঁয়ায় উপস্থিত লোকজনের চোখ জ্বলছে, ছড়াচ্ছে গন্ধও।বুধবার (৬ মার্চ) সকাল ৯টা পর্যন্ত এস আলম সুগার মিলের ভেতরে আগুন জ্বলতে দেখা গেছে। আগুন বাইরে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা না থাকলেও পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনতে আরও সময় লাগবে বলে জানান ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা।সোমবার বিকেল চারটার কিছু আগে কর্ণফুলী থানা এলাকার ইছানগরে অবস্থিত এস আলম রিফাইন্ড সুগার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের কারখানার গুদামে আগুনের সূত্রপাত হয়। গভীর রাত পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিসের ১৪টি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করে। পরে যোগ দেয় নৌ, বিমান ও সেনাবাহিনীর দল। পরদিন মঙ্গলবার সকাল থেকে ফায়ার সার্ভিসের ১০টি ইউনিট আগুন নিভানোর কাজ করে।
বুধবার সকালে সরেজমিন কারখানায় ঢুকে দেখা যায়, মূলফটক থেকে গুদাম পর্যন্ত পুরো রাস্তায় অপরিশোধিত চিনি গলে লালচে কালো কাদার মতো তরল ছড়িয়ে আছে। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা পানি ছিটাচ্ছেন। আগুনের বিস্তার ঠেকাতে গুদামের মুখে দেয়া হয়েছে বালি। গুদামের ছাদের বেশিরভাগ টিন কালো হয়ে বেঁকে গেছে। ধোঁয়া ছড়াচ্ছে আশপাশে। কারখানা এলাকার ভেতরের রাস্তায় জমা চিনি গলা আস্তরণ এস্কেভেটর দিয়ে সরানো হচ্ছে। অপরিশোধিত চিনির ধোঁয়ার তীব্রতায় উপস্থিত লোকজনের চোখ জ্বলছে। চিনি গলে যাওয়ার গন্ধও ছড়াচ্ছে। চিনির কাঁচামালের আগুনে পোড়া বর্জ্যগুলো কারখানার ড্রেন দিয়ে সোজা চলে যাচ্ছে কর্ণফুলি নদীতে। এতে করে নদী ও পরিবেশ দূষিত হচ্ছে।মঙ্গলবার পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. কামরুল হাসানের নেতৃত্বে একটি দল ঘটনাস্থলে গিয়ে নালা ও নদী থেকে পানির নমুনা সংগ্রহ করে নিয়ে আসে। তাঁরা এসব নমুনা অধিদপ্তরে পরীক্ষা করে দেখবেন পানির বিভিন্ন উপাদানের কী ক্ষতি হয়েছে। কামরুল হাসান গণমাধ্যমে বলেন, চিনিমিশ্রিত পানি নদীতে গেলে নদীর দ্রবীভূত অক্সিজেন কমে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। আরও কিছু উপাদান কমবেশি হতে পারে। সবকিছু নিশ্চিত হওয়া যাবে পরীক্ষাগারের প্রতিবেদন আসার পর।চট্টগ্রামের নেভি অ্যাংকরেজ স্কুল অ্যান্ড কলেজের রসায়ন বিভাগের প্রভাষক মো. শহীদুল ইসলাম বলেন, দ্রবীভূত অক্সিজেন কমে যাবে। সমুদ্রের পানিতে কার্বনের পরিমাণ বেড়ে যাবে। এসব কারণে নদীর পানিতে ইকোসিস্টেমে এর প্রভাব পড়বে। এর ফলে জীববৈচিত্র্য হুমকিতে পড়তে পারে।
কর্ণফুলি উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মাসুমা জান্নাত জানান, এস আলম সুগার রিফাইনারি ইন্ডাস্ট্রিজের আগুন নির্বাপণ কাজে ফায়ার সার্ভিসের পাশাপাশি সেনাবাহিনীর ১০০ সদস্য, নৌবাহিনীর ১২ সদস্যের দুটি টিম, বিমানবাহিনী, কোস্টগার্ড, র্যাব, পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্য সহযোগিতা করছেন।এস আলম সুগার মিলের জ্যেষ্ঠ ইঞ্জিনিয়ার হাসমত আলী জানান, কারখানার পুরো প্রসেসিং যন্ত্রপাতি এবং কারখানা নিরাপদ রয়েছে। আগুন যাতে ছড়াতে না পারে, সেজন্য গোডাউন থেকে কারখানার মূল প্ল্যান্টে আসার বেল্ট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়েছে।এস আলম গ্রুপের এইচ আর ম্যানেজার মোহাম্মদ হোসেন জানান, প্রাথমিকভাবে কনভেয়ার বেল্টের ঘর্ষণজনিত তাপ কিংবা বৈদ্যুতিক শটসার্কিট থেকে আগুন লাগতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
প্রাথমিক অনুসন্ধানে গুদামে যে ধরনের আগুন নেভানোর ব্যবস্থাপনা দরকার ছিল, তা ছিল না বলেই জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস।ফায়ার সার্ভিস চট্টগ্রামের উপ-সহকারী পরিচালক আবদুর রাজ্জাক জানান, প্রাথমিকভাবে গুদামটিতে আগুন নেভানোর পর্যাপ্ত ব্যবস্থা ছিল না। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা এলেও ওপর থেকে পানি ছিটানোর সুযোগ পায়নি। চারদিক থেকে বদ্ধ গুদামে উত্তপ্ত টিনের ছাদ কেটে ভেতরে ঢোকারও সুযোগ ছিল না। অল্পকিছু ফায়ার এক্সটিংগুইশার থাকলেও সেগুলো ব্যবহার করা যায়নি।তিনি বলেন, কারখানার আশপাশে ফায়ার হাইড্রেন্ট দরকার। ফায়ার হাইড্রেন্ট থাকলে এতো বেগ পেতে হতো না। আগুন নেভানো আরও সহজ হতো। এখানে ফায়ার সেফটি ইনসিকিউরড। কেননা, গোডাউনের ভেতরে ১২০০ থেকে ১৫০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় আগুন জ্বলছে। সেখানে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ঢুকতে পারছেন না। কারণ আগুনের তাপমাত্রা বেশি।
এস আলম গ্রুপের প্রধান ভূ-সম্পদ কর্মকর্তা মো. মোস্তাইন বিল্লাহ আদিল বলেন, ‘আমরা এখন আগুন নেভানোর চেষ্টা করছি, যাতে চিনিকল ও অন্য গুদামগুলোতে আগুন ছড়িয়ে না পড়ে।’আগুন লাগার পেছনে নাশকতার আশঙ্কা করছেন কি-না -- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘সরকার তদন্ত কমিটি করেছে। ফায়ার সার্ভিসসহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থা কাজ করছে। তদন্ত কমিটি তদন্ত করবে। তখন আপনারা জানতে পারবেন। এখন আমরা শুধু কারখানা রক্ষার বিষয়টি ভাবছি।’
এস আলম গ্রুপের মানবসম্পদ কর্মকর্তা মো. হোসেন বলেন, “একই স্থানে আমাদের মোট ৬টি গুদাম আছে। সোমবার ১ নম্বর গুদামে আগুন লাগে। এ গুদামটিতে ১ লাখ মেট্রিক টনের বেশি অপরিশোধিত চিনি ছিল। সবই পুড়ে গেছে। যার বাজার মূল্য হাজার কোটি টাকার বেশি। গুদামটিতে এখনও আগুন জ্বলছে।”তিনি আরও বলেন, “আমাদের ৬টি গুদামের মধ্যে চারটিতে অপরিশোধিত চিনি রাখা হয়। বাকি দুটিতে পরিশোধনের পর বিক্রি উপযোগী চিনি রাখা হয়। এক লাখ টন চিনি পুড়লেও, এখনও দুটি গুদামে বিক্রি উপযোগী ২৫ থেকে ৩০ হাজার মেট্রিক টন চিনি মজুত আছে। এছাড়াও বাকি তিনটি গুদামে বিপুল পরিমাণ অপরিশোধিত চিনি মজুত আছে। আরও চিনি আমদানি পর্যায়ে আছে। সব মিলিয়ে ৪ লাখ মেট্রিক টনের মতো অপরিশোধিত চিনি আমাদের আছে।”
এদিকে সুগার মিলে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে প্রধান করে ৯ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ও কমিটিকে আগামী সাত কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত সম্পন্ন করে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন সিএমপি পুলিশ কমিশনারের প্রতিনিধি, চট্টগ্রাম পুলিশ সুপারের প্রতিনিধি, চট্টগ্রাম ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ সুপারের প্রতিনিধি, কর্ণফুলি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাসুমা জান্নাত, চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপ-পরিচালক আবদুল মালেক, চট্টগ্রাম বিস্ফোরক অধিদপ্তরের প্রতিনিধি, চট্টগ্রাম কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের প্রতিনিধি ও কর্ণফুলি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. জহির হোসেন।
উল্লেখ্য, এস আলম সুপার রিফাইন্ড সুগার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নামে প্রতিষ্ঠানটির অবস্থান কর্ণফুলি নদীর পাড়ে ইছানগর এলাকায়। প্রায় দশ হাজার বর্গফুটের এ গুদামটি পাঁচ তলা ভবনের সমান উঁচু। সোমবার বিকেল ৪টার দিকে কারখানার ওই গুদামের ছাদের দিকেই প্রথম আগুন দেখা যায়। পরে তা পুরো গুদামে ছড়িয়ে পড়ে। আগুন লাগার সময় কারখানাটি চালু ছিল। সেখানে প্রায় সাড়ে ৫০০ শ্রমিক-কর্মচারী কাজ করেন। আগুন লাগার পর কারখানাটি বন্ধ করে দেওয়া হয়।
আপনার মতামত লিখুন :