বাংলাদেশ সোমবার, ১৭ মার্চ, ২০২৫, ৩ চৈত্র ১৪৩১

বিএনপির পররাষ্ট্রনীতির নতুন মোড়: তিস্তা রক্ষার আন্দোলন

দৈনিক প্রথম সংবাদ ডেস্ক

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২২, ২০২৫, ১২:২৭ পিএম

বিএনপির পররাষ্ট্রনীতির নতুন মোড়: তিস্তা রক্ষার আন্দোলন

বিএনপি আয়োজিত ‘জাগো বাহে তিস্তা বাঁচাই’ কর্মসূচির গণপদযাত্রা। রংপুরের কাউনিয়ায় তিস্তা সড়কসেতুতে

বিএনপি এবার ভিন্নমাত্রার এক কর্মসূচির মাধ্যমে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। তিস্তা নদী রক্ষার দাবিতে উত্তরের পাঁচটি জেলার ১১টি স্থানে দুই দিনব্যাপী অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছে দলটি। এই কর্মসূচির মধ্য দিয়ে বিএনপি শুধু পরিবেশ সচেতনতার বার্তাই দেয়নি, বরং এর সঙ্গে জড়িয়েছে কৌশলগত রাজনৈতিক বার্তাও।

শুষ্ক মৌসুমে তিস্তা নদী প্রায় মৃতপ্রায় অবস্থায় থাকে। তাই বিএনপির নেতাকর্মীরা নদীর তীরে তাঁবু খাটিয়ে, প্যান্ডেল তৈরি করে দুই দিন ধরে সেখানে অবস্থান করেছেন। তাঁরা জনসভা করেছেন, স্থানীয় মানুষের সঙ্গে কথা বলেছেন এবং তিস্তা রক্ষার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছেন। বিএনপির এই কর্মসূচি দেশের রাজনীতিতে নতুন এক মাত্রা যোগ করেছে।

বিএনপি আগে থেকেই পরিবেশ ও নদী রক্ষায় সক্রিয় ছিল। দলটির প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান দেশজুড়ে ২৬ হাজার কিলোমিটার খাল পুনঃখনন করেছিলেন। খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন পলিথিন নিষিদ্ধ করেছিলেন, যা পরিবেশ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। এবারের ‘জাগো বাহে তিস্তা বাঁচাই’ কর্মসূচি বিএনপির পরিবেশবান্ধব নীতির ধারাবাহিকতা বহন করছে।

তবে শুধু পরিবেশ ইস্যু নয়, বিএনপির এই কর্মসূচির ভেতরে রয়েছে কৌশলগত রাজনৈতিক বার্তাও। দলটি তিস্তা নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ে সরাসরি ভারতের সমালোচনা করেছে। শুষ্ক মৌসুমে ভারত তিস্তার পানি আটকে রাখে এবং বর্ষায় অতিরিক্ত পানি ছেড়ে দিয়ে উত্তরবঙ্গের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত করে। এতে স্থানীয় কৃষি, জীবিকা ও জনজীবন মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিএনপি জনসাধারণের এই ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে তাদের পাশে দাঁড়ানোর বার্তা দিয়েছে।

সমাবেশ থেকে বিএনপি জানিয়ে দিয়েছে, লড়াই করেই তারা তিস্তার পানি আনবে। প্রয়োজনে জাতিসংঘে বিষয়টি উত্থাপন করবে। ১৯৭৯ সালে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে জিয়াউর রহমান গঙ্গার পানি সমস্যার কথা বলেছিলেন, যার ফলে পরে ভারতের সঙ্গে গঙ্গা চুক্তি হয়েছিল। বিএনপি এবার তিস্তা ইস্যুতেও একই ধরনের আন্তর্জাতিক চাপ তৈরির ইঙ্গিত দিয়েছে।

বিএনপির পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে গত কয়েক মাস ধরে দলের ভেতরেই আলোচনা হচ্ছিল। বিশেষ করে ভারতের প্রতি দলটি নমনীয় অবস্থান নিয়েছে বলে সমালোচনা হচ্ছিল। তবে এবার ভারতের কড়া সমালোচনা করেছে বিএনপি। নেতারা সরাসরি বলেছেন, ভারতের ‘বড় ভাইসুলভ’ আচরণ বন্ধ করতে হবে, তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা দিতে হবে, সীমান্ত হত্যা বন্ধ করতে হবে।

একই সঙ্গে বিএনপি তিস্তা মহাপ্রকল্প বাস্তবায়নের দাবি তুলেছে। যদিও এটি চীনের একটি বড় প্রকল্প, যেটি ভারত বরাবরই বিরোধিতা করে আসছে। বিএনপির এই অবস্থান দলটির চীনের সঙ্গে সম্পর্ক নতুনভাবে জোরদারের ইঙ্গিত দিচ্ছে। অর্থাৎ, বিএনপি আবারও তার পুরনো পররাষ্ট্রনীতির দিকে ফিরে যাচ্ছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা।

তিস্তা কর্মসূচির মাধ্যমে বিএনপি শুধু পররাষ্ট্রনীতি ও পরিবেশ ইস্যুতে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করেনি, বরং এটি রাজনৈতিক কৌশল হিসেবেও বড় ধরনের পরিবর্তন এনেছে। যখন অন্যান্য রাজনৈতিক দল নির্বাচন নিয়ে বিতর্কে ব্যস্ত, তখন বিএনপি সরাসরি জনগণের মাঝে গিয়ে তাদের সমস্যার কথা বলছে।

বিএনপি জানিয়ে দিয়েছে, তারা আরও এ ধরনের জনসম্পৃক্ত কর্মসূচি পালন করবে। এই সমাবেশে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও আয়োজন করা হয়, যা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের ওপর দলটির গুরুত্ব তুলে ধরে। সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বন্ধের খবর এলেও বিএনপির এই কর্মসূচি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের প্রতি তাদের সমর্থন নিশ্চিত করেছে।

বিএনপির এই কর্মসূচির মাধ্যমে স্পষ্ট হয়েছে যে দলটি এখন নতুন ধরনের রাজনৈতিক কৌশল নিচ্ছে। তারা সরাসরি জনগণের সমস্যা নিয়ে মাঠে নামছে, জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিচ্ছে এবং পররাষ্ট্রনীতিতে নতুন দিকনির্দেশনা দিচ্ছে।

তিস্তাপাড়ের মানুষের মধ্যে এই কর্মসূচি ইতিবাচক সাড়া ফেলেছে। এতে বিএনপির সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। আগামীতে দলটি কিভাবে এই নতুন রাজনৈতিক কৌশল ধরে রাখে, তা রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হয়ে উঠেছে।

Link copied!

সর্বশেষ :